পড়শি রাজ্য ওড়িশার সঙ্গে আত্মিক টান পশ্চিমবঙ্গের। প্রত্যেক বছর বাংলা থেকেই লক্ষ-লক্ষ ভক্ত যায় এই রাজ্যের পুরীর জগন্নাথধামে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর পূর্ব ভারতের এই রাজ্যটি। তবে, এর এক অন্য দিকও আছে। ফি-বছর ঘূর্ণিঝড়ের ধ্বংসালীলায় তুমুল ক্ষয়ক্ষতি হয়। তছনছ হয়ে যায় ওড়িশার উপকূলবর্তী এলাকা। আবাদি চাষের জমি নষ্ট হয়ে যায়। লক্ষ-লক্ষ একর শস্যের ক্ষতি হয়ে যায়। তারপর আবার প্রকৃতির নিজস্ব নিয়ম মেনেই নতুন করে শস্য-শ্যামলা হয়ে ওঠে ওড়িশা। সেই ওড়িশাতেই এবার শস্য নিয়ে এক অভূতপূর্ব কাজ করে দেশের নজর কাড়ে ১২ বছরের এক মেয়ে। হর্ষিতা প্রিয়দর্শিনী মোহান্তি। জোয়ার, বাজরা, রাগীর শস্য়দানা নিয়ে ৬০'টি নতুন প্রজাতি তৈরি ও সংরক্ষণ করে চমক হর্ষিতার। ধানের বীজ ও তার বৃদ্ধি নিয়েও তাঁর কাজ প্রশংসিত হয়েছে।
কীভাবে পেলেন অনুপ্রেরণা
বীজ রোপন, বৃদ্ধি, সংরক্ষণের কাজ এত সহজ নয়। কৃষি বিজ্ঞান নিয়ে রীতিমতো পড়াশোনা করতে হয়। এত কম বয়সে বীজ তৈরি, সংরক্ষণ নিয়ে কী করে এত জ্ঞান হর্ষিতা প্রিয়দর্শিনী মোহান্তির! এর পিছনে একটি গল্প আছে। ২০২৩ সালে পদ্মশ্রী কমলা পূজারির কাছে একটি প্রোজেক্ট শুরু করে হর্ষিতা। কে এই কমলা পূজারি! কালাহান্ডি জেলার কোরাপুটের এক আদিবাসী গ্রামে জন্ম তাঁর। ১০০টি প্রজাতির বেশি ধান তৈরি করেছেন তিনি। মাচ্ছাকান্তা, উমুরিয়াচুরি, অসমচুড়ি ও জিআই ট্যাগ পাওয়া কোরাপুট কালোজিরার মতো ধানের বীজও কমলা পূজারির হাত ধরেই তৈরি। গত বছর হর্ষিতার বাবা হরেকৃষ্ণা মোহান্তি নিজে মেয়েকে নিয়ে যান। কমলা পূজারিকে অনুরোধ করেন, তাঁর মেয়েকে যেন তিনি কিছু শেখান। ৩ মাস আগে, গত ২০ জুলাই প্রয়াত হন কমলা পূজারি। তাঁর স্কুল প্রকাশ বিদ্যালয়ে ট্রেনিং নিয়ে সাফল্য পান হর্ষিতা।
সাফল্যের চাবিকাঠি
হর্ষিতা প্রথমেই বীজ সংগ্রহ করে 'ব্যাঙ্কিং' শুরু করে। হর্ষিতা ব্ল্যাক রাইস কলাবতী, হাই ফাইবার রাইস তুলসী ভোগ, রগুসাই, ছাতিয়ানাকি, হালাদিচুড়ি, এই সব বীজ ১০০ থেক ২৫০ গ্রাম করে সংগ্রহ করেছিল হর্ষিতা। এরপর বিনামূল্য়ে তা ২০ জন চাষীকে রোপনের জন্য দেওয়া হয়। এবছর আরও ৫০ জন চাষীকে বিভিন্ন বীজ ভাগ করে দেওয়া হয়। তারপরই শুরু হয়ে যায় হর্ষিতার আসল কাজ। ওই বীজ রোপনের পর তার বৃদ্ধি, সংগ্রহ নিয়ে লাগাতার কাজ করে হর্ষিতা। 'একতা' নামে এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার উদ্যোগে কোরাপুটে একটি বায়োলজিকাল ফেস্টিভেল আয়োজিত হয়। সেই উৎসবেই ৮০টির বেশি মিলেটস প্রজাতির শস্যের বীজ নিয়ে কাজ শুরু করে হর্ষিতা। তৈরি হয় অনেক প্রজাতির বীজ। এরপরই তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে দেশজুড়ে।
হর্ষিতা তার কাজের জন্য প্রথম স্বীকৃতি পায় ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে। একটি বিশ্ববিদ্য়ালয় তাকে 'কৃষক রত্ন' সম্মান দেয়। সেই শুরু। এপ্রিলে একটি জনপ্রিয় জাতীয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে প্রথম হয় হর্ষিতা। এই অনুষ্ঠানে অর্গানিক ফার্ম ও প্রাচীন বীজ নিয়ে একটি বক্তৃতা দেয় হর্ষিতা। ক্লাস সেভেনের ছাত্রীর মুখে যা শুনে মুগ্ধ হন বিচারকরাও। রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুও তার কাজকে স্বীকৃতি দেন। নয়াদিল্লির কৃষি ও কৃষককল্যাণ মন্ত্রকের একটি অনুষ্ঠানে অর্গানিক ফার্মিং নিয়ে বক্তব্য রাখে হর্ষিতা। দেশজুড়ে প্রশংসা পায় হর্ষিতা।