২০ এপ্রিল, ২০২৪। তার ঠিক ২৪ ঘণ্টা আগে রাজ্যে হয়েছে প্রথম দফার লোকসভার ভোট। দ্বিতীয় দফার প্রস্তুতি তখনও চলছে। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী ঘোষণা করলেন, 'সোমবার রাজ্যে বোমা বিস্ফোরণ হবে'।
কেঁপে গেল রাজ্য রাজনীতি। কী এমন হতে পারে ? সেই প্রশ্ন তখন রাজ্যবাসীর মনে।
২২ এপ্রিল, ২০২৪। শুভেন্দুর ঘোষণার পর কেটে গেল আটচল্লিশ ঘণ্টা। সকাল থেকে থমথমে কলকাতা হাইকোর্ট চত্বর। উদ্বিগ্ন লাখ চাকরিপ্রার্থীদের চোখ-মুখ। সকাল ১০টা থেকে শুরু হল কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চে নিয়োগ মামলার রায়দান। ২৮১ পাতার রায় পড়ে নির্দেশ দিলেন বিচারপতি দেবাংশু বসাক ও বিচারপতি সাবির রশিদি। আদালতের নির্দেশে যোগ্য-অযোগ্য মিলিয়ে রাজ্যে চাকরিহারা হলেন প্রায় ২৬ হাজার স্কুল-কর্মী।
চাকরি বাতিলের পাশাপাশি আদালত প্রশ্ন তুলল, নিয়োগ নিয়ে রাজ্য মন্ত্রিসভার অতিরিক্ত পদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েও। হাইকোর্টের নির্দেশকে হাতিয়ার করে নির্বাচনের মাঠে বাংলার শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসকে কোণঠাসা করতে উঠে পড়ে লাগল বিরোধী বিজেপি। আদালতের রায় সামনে আসতে সরব হল ডান-বাম সবপক্ষই।
নির্বাচনী প্রচারমঞ্চ থেকেই কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। চাকরিহারাদের পাশে দাঁড়িয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘোষণা, ডিভিশন বেঞ্চের এই রায়ের বিরুদ্ধে তাঁরা সুপ্রিম কোর্টে যাবেন। মুখ্যমন্ত্রীর এই ঘোষণার পরেই কোমর বাঁধতে শুরু করল স্কুল সার্ভিস কমিশন, মধ্যশিক্ষা পর্ষদ এবং রাজ্যের স্কুল শিক্ষা দফতর।
এর মধ্যেই স্কুল সার্ভিস কমিশনের সভাপতি সিদ্ধার্থ মজুমদারের দাবি, গত বছরের ডিসেম্বর মাসে হলফনামা জমা দিয়ে কলকাতা হাইকোর্টকে কতজনকে বেআইনি ভাবে নিয়োগ করা হয়েছে, তা জানানো হয়েছিল। কিন্তু তারপরেও আদালত প্রশ্ন তুলেছে অযোগ্য প্রার্থীদের সংখ্যা নিয়ে।
চাকরিহারাদের সামনে রেখে কার্যত জমে উঠল বাংলার ভোট-ময়দান। বাংলায় নির্বাচনী প্রচারে এসে কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশকে হাতিয়ার করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহও। রুখে দাঁড়ালেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়।
গত সোমবার সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছিল রাজ্য, স্কুল সার্ভিস কমিশন, মধ্যশিক্ষা পর্ষদ এবং চাকরিহারারা। প্রাথমিক শুনানির পর ৬ মে পর্যন্ত শুনানি পিছিয়ে দিলেন দেশের প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়। সোমবার নিয়োগ মামলার শুনানি করতে বসেও আরও একটা দিন সময় চেয়ে নিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট।
কিন্তু কবে থেকে শুরু হয়েছিল এই মামলা ? কেন আদালতে যেতে হয়েছি চাকরিপ্রার্থীদের ? কী ছিল তাঁদের অভিযোগ। তাহলে পিছিয়ে যেতে হয় আজ থেকে আট বছর আগে। তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের আমলে রাজ্যে স্কুলে নিয়োগের জন্য পরীক্ষা নেওয়া হল। ২০১৬ সালে স্কুলে চাকরির এই পরীক্ষার প্যানেলের বৈধতা ছিল ২০১৯ সাল পর্যন্ত। নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছিল ২০১৮ সালে। কিন্তু চার বছরের মধ্যেই কলকাতা হাইকোর্টে প্রথম মামলা দায়ের করা হয়। মামলা করা হয়েছিল গ্রুপ-সি এবং গ্রুপ-ডি পদে বেআইনি নিয়োগের অভিযোগকে কেন্দ্র করে। বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় এবং বিচারপতি বিশ্বজিৎ বসুর এজলাসে এই মামলা দায়ের হয়। প্রাথমিকভাবে ৭৮৫ জনের চাকরি বাতিল করে আদালত। পাল্টা সুপ্রিম কোর্টে যান চাকরিপ্রার্থীরা। ফের মামলা ফিরে আসে কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চে। এরইমধ্যে তৎকালীন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের নির্দেশে নিয়োগ দুর্নীতির তদন্তে সিবিআই নির্দেশ দেওয়া হয়। পৃথকভাবে তদন্তের অনুমতি পায় ইডি। গ্রেফতার করা হয় তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে। ইডি ও সিবিআই মিলিয়ে নিয়োগ দুর্নীতিতে কেন্দ্রীয় এজেন্সির জালে আরও বেশ কয়েকজন বড় নাম। তার মধ্যে ছিলেন তৎকালীন উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সুবীরেশ ভট্টাচার্য এবং নদিয়ার নাকাশিপাড়ার তৃণমূল বিধায়ক মানিক ভট্টাচার্যও।
নিয়োগ দুর্নীতির তদন্তে নেমে চোখ ছানাবড়া হয়ে যায় সিবিআইয়ের। পার্থ চট্টোপাধ্যায় ঘনিষ্ঠ অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের দুটি ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার হয় নগদ ৫০ কোটির অর্থ-সহ আরও বেশ কিছু দামী সামগ্রী। চাপ বাড়তে থাকে রাজ্যের তৃণমূল সরকারের উপরে। মন্ত্রিসভা থেকে বরখাস্ত করা হয় পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে। এই টানাপোড়েনের মধ্যেই মঙ্গলবার কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের নির্দেশের উপর অন্তর্বর্তী স্থগিতাদেশ দিয়ে চাকরিপ্রার্থীদের আপাতত স্বস্তি দিল প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়ের বেঞ্চ। ১৬ জুলাই পর্যন্ত জারি থাকবে এই স্থগিতাদেশ। যা সাময়িকভাবে হলেও স্বস্তিতে রাখল প্রায় ২৬ হাজার চাকরিহারাদের।