বৃদ্ধ হচ্ছে শহর, সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বয়স বাড়ছে কলকাতার ঐতিহ্যেরও। ডারউইনের তত্ত্ব ‘সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট’, অর্থাৎ সময়ের চোখে যোগ্যতমই জায়গা করে নেয়। উবার, ওলা বিভিন্ন অ্যাপ ক্যাবের সঙ্গে যোগ্যতার দৌড়ে কী কী কারণে পিছিয়ে পড়তে হল হলুদ ট্যাক্সিকে?
২০০৮ সালে কলকাতা হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছিল, ১৫ বছরের পুরানো কোনও বাণিজ্যিক গাড়ি কলকাতার রাস্তায় চলতে পারবে না। দেখতে দেখতে সে দিন এসেই গিয়েছে। অথচ শুরুটা হয়েছিল ১ শতাব্দী আগে।
১৯০৯ সালে কলকাতা রাস্তায় প্রথম নামে ট্যাক্সি। তবে সে ট্যাক্সি আজকের মতো ছিল না। সেই গাড়িতে কেবল দুজন যাত্রীর বসার সুযোগ পেতেন। ভাড়ার কারণে অভিজাত পরিবার ছাড়া সেই ট্যাক্সিতে চড়ার সাহস তৎকালীন যুগে দেখাতেন না প্রায় কেউই। চৌরঙ্গী থেকে দমদম ব্যারাকপুর বজবজ এই রুটে চলত কেবল ট্যাক্সি। রঙ ছিল টকটকে লাল। শোনা যায়, কলকাতা শহরে এই নতুন বাহন দেখতে রাস্তায় ভিড় জমাতেন অনেকেই।
সময়ের সাথে সাথে খোলস বদলালো এই চার চাকার গাড়ি। বাজারে এল নতুন রূপে। সালটা ১৯৫৮, অ্যাম্বাসাডর গাড়ি তৈরি করে শিল্পের জগতে বিপ্লব আনল হিন্দুস্তান মোটোরস। যে গাড়িতে অনায়াসে বসতে পারেন ৪জন।
প্রায় বছর চারেক পর, ১৯৬২ সালে কলকাতায় ট্যাক্সি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এই অ্যাম্বাসাডর। ৬০-৭০ এর দশকে কলকাতার রাজপথে রাজ করতে শুরু করে কালি-পিলি ট্যাক্সি। ইন্টারসিটি সার্ভিসের জন্য পুরো হলুদ আর শহরের মধ্যের রাস্তার ঘোরার জন্য হলুদ–কালো — এই ছিল ট্যাক্সির দু’রকমের ভাগ। পরে অবশ্য কালো রং উঠে গিয়ে সবটাই হলুদ ট্যাক্সি হয়ে গিয়েছিল। ক্রমে এই ট্যাক্সিই হয়ে ওঠে তিলোত্তমার অন্যতম ‘আইকন’। তবে ২০১৪ সালে বন্ধ হয়ে যায় হলুদ ট্যাক্সির ‘জন্মদাতা’ হিন্দুস্তান মোটরস। বন্ধ হয়ে যায় অ্যাম্বাসাডর উৎপাদনও।
বেঙ্গল ট্যাক্সি অ্যাসোসিয়েশন , প্রোগ্রেসিভ ট্যাক্সি ইউনিয়ন AITUC অনুমোদিত ট্যাক্সি সংগঠন ,ক্যালকাটা ট্যাক্সি অ্যাসোসিয়েশন মিলে তৈরি হয়েছে, ওয়েস্ট বেঙ্গল জয়েন্ট ফোরাম অব ট্যাক্সি অ্যাসোসিয়েশন। এই বিষয়েই ‘হারানো সুরে হলুদ ট্যাক্সি’ নামে একটি আলোচনাসভার আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানেই আলোচনা হয়েছে হলুদ ট্যাক্সির ভবিষ্যৎ নিয়ে। এত প্রত্যাখানের পরেও কীভাবে শহরে রেখে দেওয়া যায় এই হলুদ চর্চাকাকর যান, তা নিয়ে আলোচনা চলছে সর্বস্তরে। সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার চিন্তাভাবনাও চালাচ্ছে রাজ্য সরকার।
শুরুতেই বলেছিলাম ডারউইন-এর তত্ত্ব বলছে সময়ের খাতায় যোগ্যতমই শ্রেষ্ঠ। কিন্তু এই যোগ্যতার বিচার করবে কে? যোগ্যতম হয়ে উঠতে কলকাতা ট্যাক্সিকে কতটুকুই বা সময় দেওয়া হল? এক ফোনে যেখানে, ন্যায্য ভাড়ায় বাড়ি থেকে যাত্রী তুলে দিয়ে অ্যাপ ক্যাব পৌঁছে দিচ্ছে গন্তব্যে, সেখানে হলুদ ট্যাক্সিকে যোগ্য হতে গেলে যা যা করা প্রয়োজন, তার সুযোগ কি আর পাবে এই গণপরিবহন? নাকি সবেধন নীলমণি যে কয়েক হাজার হলুদ ট্যাক্সি এখনও কলকাতায় হলুদ রঙ ছিটিয়ে দেয়, তারাও ক্রমে ফিকে ফিকে হতে বিলুপ্তির কোলে ঢলে পড়বে? তা তো সময়ই বলবে।
হাড়গোড় বেরিয়ে কঙ্কালসার অবস্থা কলকাতার হলুদ ট্যাক্সির। সঙ্গে চালকদের প্রত্যাখ্যান এবং দুর্ব্যবহারের প্রসঙ্গ বারংবার উঠে এসেছে যাত্রীদের মুখে মুখে। সেখান থেকেই প্রশ্ন উঠছিল টিকে থাকার চেষ্টা আদৌও কতটা ছিল এই যানের?