'তোমরা হাত রাখো
ঠিক আমার বুকের ওপরে
শোনো
হৃদয়ের ধুকপুক এ নয়
গর্জন আর হুঙ্কার শোনো
একটা সিংহের বাচ্চা আমাকে
শান্তি দিচ্ছে না'।
বিংশ শতকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রুশ শিল্পী ভ্লাদিমির মায়াকোভস্কির লেখা অনুবাদ করার সময়ে লিখেছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। 'একটা সিংহের বাচ্চা আমাকে শান্তি দিচ্ছে না', এ যেন রাজনীতিবিদ ও প্রশাসনিক প্রধান বুদ্ধদেবের জীবনের ক্ষেত্রেও অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। যেখানে শাসক দলের প্রথমসারির নেতা থেকে ক্রমে শাসক দলের সবথেকে জনপ্রিয় 'ব্র্যান্ড' হওয়ার পরেও, তাঁকে ঘিরে থাকা আলোর বলয়কে অতিক্রম করেই তিনি কখনও কখনও তীব্রভাবে চেয়েছিলেন নিভৃতি। যে নিভৃতিতে, নতুন কিছু সৃষ্টির আশায়, মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সঙ্গে বারেবারে দেখা হয়েছে পাঠক ও সাহিত্যিক বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের। যেখানে প্রখ্যাত রাজনীতিবিদকেও শান্তি দিচ্ছে না কী এক আশায় বেঁচে থাকা শিল্পীসত্তা।
১৯৯৩ সালে তিনি 'দুঃসময়' নাটকটি রচনা করেছিলেন৷ যার মূল বিষয় ছিল সাম্প্রদায়িক হানাহানির বিরুদ্ধে মানবতার জয়৷ বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরে প্রকাশিত হওয়া এই নাটকটি সদর্থক কারণেই রীতিমতো আলোড়ন তুলেছিল তখনকার বঙ্গসমাজে। অনুবাদ করেছিলেন ফ্রানজ কাফকার বিখ্যাত গল্প 'মেটামরফসিস'-এর। যার নাম দিয়েছিলেন 'পোকা'। অনুবাদ সাহিত্যের প্রতি বিশেষ আগ্রহ ছিল রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের বিখ্যাত উপন্যাসের অনুবাদ করেছিলেন তিনি 'চিলিতে গোপনে' নামে। যা পাঠক ও বিশেষজ্ঞমহলে রীতিমতো সমাদৃত হয়। মার্কেজের আরও একটি বিখ্যাত নন-ফিকশনের অনুবাদ করেন 'বিপন্ন জাহাজের নাবিকের গল্প' নাম দিয়ে।
ইতিহাস-চর্চা ছিল তাঁর পড়াশোনার অপর একটি গভীর দিক। হিটলারের নেতৃত্বে নাৎসি জার্মানির জন্ম ও তার ক্রমে বিলীন হয়ে যাওয়ার গোটা সময়টি নিয়েও লিখেছিলেন বই। যা একইরকম সমাদর পেয়েছিল পাঠকদের কাছে।
বারবার তিনি বলে গিয়েছেন, রাজনীতির পাশাপাশিই জ্ঞানচর্চা ও শিল্পচর্চা তাঁর যাপনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। সেই জ্ঞানচর্চার অংশ হিসেবেই তিনি পড়েছেন, তিনি জেনেছেন, এবং লিখেছেন সাহিত্য থেকে নাটক, ইতিহাস থেকে রাষ্ট্রবিদ্যা পর্যন্ত নানা বিষয়ের নানা বই।
তাঁর প্রয়াণে, কর্মব্যস্ত রাজনৈতিক জীবনের পাশাপাশি নীরবে ও নিভৃতে প্রকৃত জ্ঞানচর্চা ও মেধার প্রতি নিবিষ্ট থেকে নতুন কিছু সৃষ্টি করার অভ্যাসের ধারাটির একটি অধ্যায়েরও সমাপ্তি হল।