হাতে রয়েছে এক বছরের বেশি সময়। আর এই সময়ের মধ্যেই সরকার এবং তৃণমূলকে নতুন করে গুছিয়ে নিতে চান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজনৈতিক মহলের দাবি, তৃণমূলের একটি সমীক্ষা দাবি করছে, এই সময়ে দাঁড়িয়ে ভোট হলে বঙ্গ বিজেপির আসন কমে দাঁড়াতে পারে ৫০-এর নিচে। যা তৃণমূল নেত্রীকে আরও গুছিয়ে নিতে সাহায্য করছে বলেও মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল।
সদ্য রাজ্যে হয়ে গিয়েছে ছটি কেন্দ্রে উপ-নির্বাচন। ভোটের আগে সবার মনে প্রশ্ন ছিল, এই ভোটে কী আরজি করের ঘটনার প্রভাব পড়বে ? এই প্রশ্নের পিছনে ছিল দুটো কারণ। প্রথম কারণ হিসাবে দেখা গিয়েছিল সরকারি হাসপাতালে মহিলা চিকিৎসককে ধর্ষণ করে খুনের ঘটনায় প্রবল চাপের মধ্যেই ছিলেন প্রশাসক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর ১৩ বছরের শাসন ব্যবস্থায় এই ঘটনায় প্রথমবার মমতার বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলন দেখা গিয়েছিল। তবে, সেটা ছিল শুধুমাত্র কলকাতার মধ্যে সীমাবন্ধ। তবুও, তাঁর সরকারকে কার্যত মাথা ঝোঁকাতে হয়েছিল। ঘটনার জেরে সাসপেন্ড করতে হয়েছিল আরজি করের অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষকে। সরিয়ে দিতে হয়েছিল কলকাতা পুলিশের তৎকালীন কমিশনার বিনীত গোয়েলকেও।
তবে, এই ম্যাচের দ্বিতীয়ার্ধ অবশ্যই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। যার প্রমাণ গত ২১ অক্টোবরের নবান্ন বৈঠক। এই বৈঠকের পর থেকেই ক্রমশ থিতিয়ে গিয়েছে আরজি কর আন্দোলন। রাজপথে দেখা নেই নাগরিক সমাজের। রাজনৈতিক মহলের দাবি, ওই একটা বৈঠক আরজি কর পরবর্তী সময়ে হওয়া ছয় উপ-নির্বাচনের উপরে কার্যত কোনও প্রভাব ফেলতে দেয়নি।
পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৬ বিধানসভা ভোটের ময়দানেও আগে কার্যত এগিয়েই শুরু করতে চলেছে বাংলার শাসক দল। গত লোকসভা ভোটের পর থেকে হওয়া রাজ্যের উপ-নির্বাচনের স্কোর কার্ডে লেখা হয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস ১০, বিরোধীরা ০। এরমধ্যে গত বিধানসভায় নিজেদের জেতা আসনে হেরেছে বিজেপি।
আরজি কর কাণ্ডের আগে ও পরে ভোটের বাক্সে এই ফল কার্যত তৃণমূল নেত্রীর আত্মবিশ্বাসকে দ্বিগুণ করেছে। তাই, কালীঘাট হোক বা বিধানসভা, প্রতি বৈঠকে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন, এখনও তিনি-ই তৃণমূলের শেষ কথা। তৃণমূলের একাংশ থেকে দাবি করা হয়েছে, এটাই স্বাভাবিক। কারণ, বাংলা কী চায়, এটা মমতার থেকে ভাল কেউ বোঝেন না। একইসঙ্গে ওই মহল থেকেই দাবি, সরকার ও দলকে কড়া বার্তা দিয়ে মমতা বুঝিয়ে দিয়েছেন এখন তিনি কতটা আক্রমণাত্মক।
সেই কারণে, রাজ্যে সাম্প্রতিক উপ-নির্বাচনে তাঁর হাতিয়ার ছিল স্থানীয় মুখ। তিনি এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় কেউ এই ভোটের প্রচারে যাননি। তারপরেও সিতাই এবং হাড়োয়ার মতো কেন্দ্রে তৃণমূল প্রার্থীরা জিতেছেন লক্ষাধিক ভোটে। মার্জিন বেড়েছে নৈহাটি, তালড্যাংরার মতো আসনেও।
এই সমীকরণের উপরে দাঁড়িয়েই ২০২৬-কে পাখির চোখ করতে চান তৃণমূল নেত্রী। সরকার ও দলে নিজের হাতে রাশ রেখেই নামতে চান ভোট ময়দানে। সম্প্রতি বিধানসভার বৈঠকেই তিনি স্পষ্ট করে দিয়েছেন, তিনি বিশ্বাস করেন টিম গেমে। তাই সেখানে ব্যক্তিগত বলে কিছু নেই।
২০২১ পরবর্তী সময় থেকেই তৃণমূলের অন্দরে নবীন বনাম প্রবীণ নিয়ে একটা গুঞ্জন চলছিল। তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর দলকে নিজের মতো করে সাজাতে চেয়েছিলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, একটা লাইন পর্যন্ত সেই ছাড় অভিষেককে দিয়েছিলেন মমতা। কিন্তু কখনই লক্ষ্মণরেখা অতিক্রম করতে দেননি। অভিষেক চেয়েছিলেন তৃণমূলে এক ব্যক্তি এক পদ। মমতা মনে করেন, তৃণমূল একটা পরিবার। একটা টিম। যারা একসঙ্গে আক্রমণে যাবে। প্রয়োজনে সবাই মিলে ডিফেন্স করবে।
আর সেটাই যে হবে, তা কালীঘাটের গত বৈঠকেই স্পষ্ট করে দিয়েছেন। আপাতত তৃণমূলে প্রবীণদের হাতে রাশ রেখে তৃণমূল নেত্রী বুঝিয়ে দিয়েছেন, আগামী বিধানসভা ভোটে তাঁর মডেলেই চলবে বাংলার শাসক দল। সেই কারণে, বিধানসভার বৈঠকে বিধায়কদের স্পষ্ট বার্তা কোনও সমীক্ষা সংস্থার ফোন ধরার প্রয়োজন নেই। কারণ, তিনি চান না ভোটের ময়দানে কোনও প্রভাব খাটাক আই-প্যাকের মতো সংস্থা।
গত কয়েকদিন ধরেই অভিষেকের জন্য ব্যাট ধরে রাজ্য রাজনীতির হাওয়া গরম করার চেষ্টা করেছিলেন ভরতপুরের তৃণমূল বিধায়ক হুমায়ুন কবীর। ওয়াকিবহাল মহলের মতে, মমতার কার্যত রুদ্রমূর্তিতে তিনিও এখন পিছু হঠেছেন। ক্ষমা চেয়েছেন দলের কাছে।
বার্তা খুব পরিষ্কার। ভোট হবে মমতা মুখকে সামনে রেখে। তৃণমূল নেতারাও জানেন, নেত্রী ছাড়া বিকল্প কেউ নেই। কারণ, মাস্টারস্ট্রোকের নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।