কলকাতা শহরের চারিদিকে ছড়িয়ে রয়েছে একাধিক ব্রিটিশ স্থাপত্য। তার মধ্যে অন্যতম একটি ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল। ইউরোপীয় সংস্কৃতির স্পর্শ রয়েছে এই স্মৃতি সৌধের মধ্যে। প্রায় ৬৪ একর জায়গা জুড়ে রয়েছে কলকাতার এই ভাস্কর্যটি। আর জনপ্রিয়তার নিরিখে নাকি তাজ মহলের ঘাড়েই নিঃশ্বাস ফেলছে শ্বেত পাথরের তৈরি এই ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল। কিন্তু আপনি কি জানেন? সাদা রঙা এই জনপ্রিয় ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালকে একবার পুরো কালো রঙ করে দেওয়া হয়েছিল।
সালটা ১৯৪৩। ওই বছরই নাকি শ্বেত পাথরের তৈরি ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালকে সম্পূর্ণ কালো রঙে ঢেকে ফেলেছিল তৎকালীন ইংরেজ সরকার। ইতিহাস বলছে, সময়টা চল্লিশের দশক। ব্রিটেনের গদিতে তখন ষষ্ঠ জর্জ। কলকাতা সেইসময় ব্রিটেনের হাতে পরাধীন ভারতের রাজধানীর তকমা হারিয়েছে। কলকাতায় বেশ কিছু সরকারী কার্যালয় থাকলেও, ক্রমেই তখন জোরালো হতে শুরু করেছে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রতিবাদ।
একই সঙ্গে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছিল সেই সময়। ভারত সরাসরি বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ না করলেও কলকাতায় খাতায় কলমে তখন ব্রিটিশ রাজত্ব চলছে। ফলে কলকাতা স্বাভাবিক ভাবেই জাপানের শত্রুপক্ষের ঘাঁটি হিসেবে পরিণত হয়েছিল। এদিকে ততদিনে জাপানের বায়ুসেনা রীতিমতো ত্রাসে পরিণত হয়েছে সকল দেশের কাছে। সেই আবহে ব্রিটেন এবং আমেরিকাকে বিপদে ফেলতে জাপানি সেনা কলকাতায় বোমাবর্ষণ শুরু করে।
মূলত রাতের বেলায় জাপানি সেনা হামলা চালাত কলকাতায়। সেই সময়ে একাধিক পন্থায় জাপানের হাত থেকে বাঁচার চেষ্টা চালাচ্ছিল কলকাতার মানুষ। রাত হলেই শহরের ঘর বাড়ি সব কালো কাগজে ঢেকে দেওয়া হত। কিন্তু রাতের ভিক্টোরিয়ার রূপের দিক থেকে তো তখন চোখ ফেরানো দায়। ১৮৪ ফুটের ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল রাত হলেই ঝকঝক করে উঠত। পূর্ণিমা রাতে রূপ বাড়ত দ্বিগুণ। ফলে বেজায় চিন্তায় পড়েছিল তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার। কারণ এই ঝকঝকে স্থাপত্যকে জাপানি সৈন্যদের হাত থেকে রক্ষা করার কোনও উপায় খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না।
এরপর ব্রিটিশ সরকার যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেয়। ভিক্টোরিয়াকে ঢেকে দেওয়া হয় ছদ্মবেশে। প্রথমে ভিক্টোরিয়ার চারপাশে বাঁশের কাঠামো বানানো হয়। এরপর মাটি আর গোবরের মিশ্রণ লেপে দেওয়া হয় ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের গায়ে। ব্রিটিশরা চায়নি, কোনও ভাবেই এই কথা জাপানিদের কানে যাক। সেই কারণে কালো ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়্যালের কোনও ছবিও তুলতে দেওয়া হয়নি সেই সময়ে।
ব্রিটিশ সরকারের সিদ্ধান্তের ফলে জাপানি আগ্রাসনের হাত থেকে রক্ষা পায় ভিক্টোরিয়ার। দীর্ঘ সময়ের পর জাপানি হামলার আতঙ্ক কাটলে ভিক্টোরিয়ার কালো প্রলেপ তুলে ফেলা হয়। ঘষেমেজে আবার স্বমহিমায় ফিরিয়ে আনা হয় সাদা ইমারতের এই সৌধকে। যে সৌধ আজ কলকাতার অন্যতম আকর্ষণ।
কেন তৈরি করা হয়েছিল ভিক্টোরিয়া?
ব্রিটিশ শাসন চলাকালীন কলকাতা ছিল দেশের রাজধানী। ১৮৫৭ থেকে ১৯০১-এর ২২ জানুয়ারি এই দীর্ঘ সময় ধরে ইংল্যান্ডের রানী ভিক্টোরিয়া ভারতের সম্রাজ্ঞী ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর ভারতীয় উপনিবেশে তাঁর স্মৃতি তৈরির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তাজমহলের আদলে বানানোর সিদ্ধান্ত হয়েছিল এই স্মৃতিসৌধ। সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছিল ইউরোপীয় সংস্কৃতির স্পর্শ। রানির নামে ওই সৌধের নাম রাখা হয় ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল।
ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল তৈরির প্রস্তাব করা হয় ১৯০১ সালে। আর এই সৌধ তৈরির জন্য বেছে নেওয়া হয় গড়ের মাঠের প্রেসিডেন্সির জেলের জমি। যদিও ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল তৈরির প্রস্তাবের পর প্রেসিডেন্সি জেল সেই জমি থেকে আলিপুরে স্থানান্তরিত করা হয়। ভিক্টোরিয়ার প্রস্তাব পাশের পর প্রায় পাঁচ বছর ধরে তার নকশা তৈরি সহ অন্যান্য কাজ এগোতে থাকে।
১৯০৬ সালে শুরু হয় সৌধ নির্মাণের কাজ। কাজ শেষ হতে সময় লাগে প্রায় ২০ বছর। সব মিলিয়ে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল নির্মাণ শেষ হয় ১৯২১ সালে। সেই সময় স্মৃতি সৌধ তৈরি করতে খরচ পড়েছিল প্রায় ১ কোটি ৫ লক্ষ টাকা। যার সবটাই এসেছিল দেশের রাজা-মহারাজা আর সাধারণ মানুষের পকেট থেকে।