বহু বছর আগের এক সকাল। আগের রাতে শান্তিনিকেতন প্রবল ঝড়বৃষ্টি হয়েছে। ভোরবেলা উপসানাস্থলে বছর ষোলর এক মেয়েকে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জিজ্ঞেস করলেন, 'কাল রাতে মেঘের ডাকে ভয় পাওনি তো?' মেয়েটি দ্বিধাজড়ানো গলায় উত্তর দিয়েছিল, 'না, লাগেনি'।
কোচবিহারের রাজকুমারী, পরবর্তীকালে জয়পুরের মহারানি গায়ত্রী দেবীর জীবন আমাদের বলে দেয়, তিনি সম্ভবত কিছুতেই ভয় পেতেন না। না বন্য জীবজন্তুকে, না তিহার জেলকে। এক অদ্ভুত বর্ণময় জীবন কাটিয়েছেন গায়ত্রী দেবী। অপার সৌন্দর্য, বিপুল বৈভব, অসামান্য ফ্যাশন, চোখ ঝলসে যাওয়া গ্ল্যামার আর অনন্ত রহস্যের আশ্চর্য মিশেল তাঁর জীবন।
জন্ম কোচবিহারের রাজপরিবারে, পড়াশোনা শান্তিনিকেতনে এবং ব্রিটেনের অভিজাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। দক্ষ অশ্বারোহী, দুর্দান্ত শিকারী, ভারতের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ স্টাইল আইকনদের একজন গায়ত্রী ভীষণ ভালোবাসতেন গাড়ি চালাতে৷ ছিলেন ভারতের প্রথম মার্সিডিজ বেঞ্জের মালিক। শুধু কী তাই! একগুচ্ছ রোলস রয়েস এবং এয়ারক্রাফটও ছিল তাঁর। আজ, ২৩ মে তাঁর ১০৫ তম জন্মবার্ষিকী।
অনন্ত বৈভবের জীবন ছিল গায়ত্রীর, কিন্তু তার মধ্যেই তিনি ছিলেন স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। কোচবিহারের মহারাজা জীতেন্দ্র নারায়ণ আর বরোদার রাজকুমারী ইন্দিরা রাজের মেয়ে গায়ত্রীর যখন মাত্র ১২ বছর বয়স, তখন কলকাতায় পোলো খেলতে এসেছিলেন সোয়াই মান সিং। গায়ত্রীকে দেখে মুগ্ধ হন তিনি৷ প্রায় ৬ বছর পর দুজনের চার হাত এক হয়। গায়ত্রী নিজেও ছিলেন একজন অসাধারণ অশ্বারোহী, আর সেই সঙ্গে এক দুর্দান্ত পোলো খেলোয়াড়। তাঁর বন্দুকের নিশানা ছিল অব্যর্থ। মাঝেমধ্যেই বেরিয়ে পড়তেন শিকারে। খুব কম বয়স থেকেই গায়ত্রী ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্টাইল আইকন৷ 'ভোগ' পত্রিকার জন্য তাঁর ছবি তোলেন বিশ্ববরেণ্য ফটোগ্রাফার সিসিল বিটন৷ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ১০ সুন্দরীর একজন ছিলেন গায়ত্রী। অনেক বছর পরে, ২০০৪ সালে, বৃদ্ধা গায়ত্রী একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তাঁর সাজতে ভালো লাগত না। মা জোর করতেন, তাই লিপস্টিক পরতেন৷ শারীরিক সৌন্দর্য তাঁকে কখনওই তেমন আকর্ষণ করেনি।
একজন মানুষের চরিত্রে ঠিক কতগুলি শেড থাকতে পারে, তা হয়তো খানিকটা বোঝা যায় গায়ত্রী দেবীর দিকে তাকালে। যে মানুষটি দেশের সেরা সুন্দরী, বিশ্বময় যাঁর ফ্যাশনের খ্যাতি, সেই তিনিই আবার 'ব্লু পটারি'র মতো বিলুপ্তপ্রায় শিল্প রক্ষার্থে জীবনপণ করে লড়েছেন। জয়পুরে তৈরি করেছেন দুটি স্কুল- একটি 'মহারানী গায়ত্রী দেবী গার্লস পাবলিক স্কুল', অন্যটি স্বামীর নামে- 'মহারাজা সোয়াই মান সিং বিদ্যালয়'। এহেন গায়ত্রীই আবার ঝাঁপিয়ে পড়লেন রাজনীতিতে। যোগ দিলেন কট্টর কংগ্রেস বিরোধী স্বতন্ত্র পার্টিতে। ১৯৬২ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিশ্বরেকর্ড গড়ে জয়ী হলেন তিনি৷ ১৯৬৭ এবং ১৯৭১ সালের নির্বাচনেও তিনি জয়ী হন।
১৯৬৫ সালে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক চলাকালীন কংগ্রেসে যোগদানের প্রস্তাব পান গায়ত্রী। তাঁর স্বামী তখন স্পেনে ভারতের রাষ্ট্রদূত। কিন্তু নিজের অবস্থানে অনড় থেকে ফিরিয়ে দেন কংগ্রেসে যোগদানের প্রস্তাব।
এরপর এল ১৯৭৫ সাল। জারি হল জরুরি অবস্থা। পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক কারণে গ্রেফতার হলেন রাজমাতা গায়ত্রী দেবী৷ টানা সাড়ে ৫ মাস তিহার জেলে কাটাতে হল। এরপর থেকেই একটু একটু করে রাজনীতির ময়দান থেকে সরে আসেন গায়ত্রী।
২০০৯ সালে তাঁর মৃত্যুতে অবসান হয়েছিল এমন এক জীবনের, যা প্রকৃতঅর্থেই উপন্যাসোপম। ২০০৯ সালের ২৯ জুলাই সেই উপন্যাসের শেষ রচনা হল ঠিকই, কিন্তু রহস্যময় সৌন্দর্য, আভিজাত্যের চূড়ান্ত পরাকাষ্ঠা, ফ্যাশন আর স্টাইলের রোলমডেল রয়ে গেলেন মহারানি। গায়ত্রী দেবী চিরনবীনা! আধুনিক ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ বিউটি আইকন!