উত্তরবঙ্গের মালদহ থেকে কলকাতা ময়দান। কতটা পথ পেরলে তবে ফুটবলার হওয়া যায়, উত্তাল সত্তরের শুরুতে বাঙালিকে দেখিয়েছিলেন উনিশ বছরের এক যুবক। প্রতিপক্ষের জাল ছিঁড়েছে তাঁর পায়ে। তাঁর মগজাস্ত্রে নতজানু হয়েছে বেকতেরো সাসানার মতো প্রতিপক্ষ ক্লাবের মাথা। ময়দানের সেই ‘বুলডোজার’, সেই ‘গডফাদার’ আর নেই। প্রয়াত সুভাষ ভৌমিক। শনিবাসরীয় ভোরে ময়দান নিঃস্ব।
জন্ম ১৯৫০ সালের দোসরা অক্টোবর। আন্তঃজেলা স্কুল ফুটবলে প্রখমে নজরে আসে ছোট্ট সুভাষ। ১৯৬৯ সালে মালদহ থেকে সোজা ময়দান ইস্টবেঙ্গল তাঁবুতে তাঁর যোগদান। একবছরের মাথায় ক্লাব বদল। লাল-হলুদ থেকে এবার সবুজ-মেরুন। সালটা ছিল ১৯৭৩। ফের ফিরে আসা ইস্টবেঙ্গলে। এরপর টানা তিন বছর লাল-হলুদকে তাঁর সেরাটা দিয়েছিলেন ততদিনে ময়দানে বুলডোজার নামে বিখ্যাত সুভাষ ভৌমিক।
খেলোয়াড় জীবনে গুরু মানতেন প্রয়াত পি কে বন্দ্যোপাধ্যায়কে। পিকেও তাঁর প্রিয় ছাত্রকে আদর করে ডাকতেন ‘ভোম্বলবাবু’ নামে। সেই সুভাষই ছিলেন ১৯৭৫ সালে আইএফএ শিল্ড ফাইনালে মোহনবাগানকে ৫-০ গোলে হারানোর অন্যতম নায়ক। ১৯৭৯ সালে ইস্টবেঙ্গল জার্সিতে ময়দানকে বিদায় জানিয়েছিলেন ফুটবলার সুভাষ। কিন্তু ময়দান তাঁকে আলবিদা জানায়নি। বরং নতুন সুভাষকে চিনিয়ে ছিল গড়ের মাঠ। এবার কোচের ভূমিকায়।
দেবজিৎ ঘোষ থেকে অ্যালভিটো ডি’কুনহা। দীপক মণ্ডল থেকে সুরকুমার সিংয়ের একদা গডফাদারের নাম সুভাষ ভৌমিক। ‘সব ঠিক যাবে’- এই বার্তাতেই দলকে আগলে রাখতেন। কখনও দাদা সুভাষ তো আবার কখনও স্যর সুভাষ হয়ে। বিদেশি ফুটবল সম্পর্কে তাঁর অধ্যাবসায় ছিল কোচ সুভাষের সাফল্যের চাবিকাঠি। সে কারণে ময়দানে প্রথম জাকুজি বসেছিল ইস্টবেঙ্গল তাঁবুতে। রোজ মাঠে যাওয়া শত শত ইস্টবেঙ্গল সমর্থক দেখেছিলেন ভারতীয় ফুটবলে বিদেশি অনুশীলনের ছোঁয়া।
ঠিক যেখানে শেষ করেছিলেন, ঠিক সেখান থেকেই শুরু। ফুটবলার সুভাষ ইতি টেনেছিলেন ইস্টবেঙ্গলে। কোচ সুভাষ শুরু করলেন ইস্টবেঙ্গল থেকেই। তবে লাল-হলুদে কোচ সুভাষের রূপকথা ২০০২ থেকে ২০০৫। দু’বার আই লিগ, ত্রিমুকুট, এবং সর্বপরি ২০০৩ সালে জার্কাতায় বেকতেরো সাসানাকে হারিয়ে আশিয়ান কাপ জয়। এই সবই এই তিন বছরের মধ্যে।
কোচ সুভাষকে সুভাষকে দেখা গিয়েছিল মহমেডান স্পোর্টিং এবং মোহনবাগানেও। কিন্তু সেখানে সাফল্য ছিল না। তবে তাঁর জীবনের শেষ সাফল্য গঙ্গাপারে নয়, মাণ্ডবী নদীর তীরে। এ লাইসেন্স ছিল না। তাই কোচ নয়, টেকনিক্যাল ডিরেক্টর সুভাষ ভৌমিকের প্রখরতায় আই লিগ জয় করেছিল চার্চিল ব্রাদার্স।
বরাবরই সোজাসাপটা। তাই বিতর্ক ছিল তাঁর সঙ্গী। কিন্তু মাঠের বাইরে তাঁর জীবনে বিতর্ক ছুঁয়ে গিয়েছিল এক ঘুষকাণ্ডকে কেন্দ্র করে।
২২ জানুয়ারির ভোরে একবালপুর নার্সিংহোমে সব অতীত হয়ে গেল। ময়দান আজ নিঃস্ব। থেকে গেল ‘বুলডোজার’ থেকে ‘গডফাদার’ হয়ে ওঠা সুভাষ ভৌমিকের রূপকথা।