চার বছর আগের কাজান। সেদিন মেসির যন্ত্রণা মাখা মুখটা দূর থেকে বসেই দেখেছিলেন তিনি। কারণ, চার বছর আগের রাশিয়ায় তিনি ছিলেন একজন আম আর্জেন্টাইন। তাই গ্যালারি থেকেই নায়কের কান্নাকে অনুভব করেছিলেন। চার বছর পর কাতার। তাঁর হাতেই অভিশপ্ত লুসাইলে ৩৬ বছর পর শাপমুক্তি আর্জেন্টিনার। ফ্রান্সকে টাইব্রেকারে চার-দুই গোলে হারানোর নায়ক আর্জেন্টিনার গোলকিপার এমি মার্টিনেজ। এমবাপের কাছে তিন গোল খেয়ে পেনাল্টি বাঁচাতে দাঁড়িয়েছিলেন। সার্জিও গাইকোচিয়ার এই উত্তরসূরির দস্তানায় রবিবার আটকে গেল ফ্রান্সের চ্যাম্পিয়ন ভাগ্য। আর যিনি ফিনিশ করলেন সেই গঞ্জালো মন্ট্রিয়েলের জন্ম দেশের বিশ্ব জয়ের ঠিক ১১ বছর পর। এতদিন বিশ্বকাপ জয়ের গল্প শুনেছিলেন। রবিবাসরীয় কাতারের টাইব্রেকারে তাঁর গোলেই চার বছর আগে ফ্রান্সের কাছে হারের দেনা শোধ করে বিশ্বকাপ হাতে তুললেন লিওনেল মেসি।
এবারের শুরু থেকেই কাতারের আর্জেন্টিনার ভাগ্য যেন ১৯৮৬ আর ১৯৯০ সালের মিশ্রণ। কখনও গ্রুপের ম্যাচে হোক। আবার কখনও নক-আউটে। ফাইনালেও বেশ কিছুটা সময় মিলে গেল আজ থেকে ৩৬ বছর আগের মেক্সিকো সিটির সেই ম্যাচের সঙ্গে। ওই ম্যাচে ২২ মিনিটে তৎকলীন পশ্চিম জার্মানির বিরুদ্ধে আর্জেন্টিনাকে এগিয়ে দিয়েছিলেন হোসে ব্রাউন। আর এই ম্যাচে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে আর্জেন্টিনার লিড ২৩ মিনিটে মেসির পেনাল্টি থেকে করা গোলে। কাতারে মেসিদের লিডের কান্ডারি ডি মারিয়া। ম্যাচের বয়স তখন ৩৮ মিনিট।
৩৬ বছর আগে ৫৬ মিনিটে জর্জে ভালদানোর গোলে ২-০ গোলে এগিয়ে ছিল মারাদোনার দল। ৭৪ আর ৮২ মিনিটে পশ্চিম জার্মানিকে সমতায় ফিরিয়েছিলেন রুমেনিগে এবং রুডি ভয়লার। ৩৬ বছর পর এক ফরাসি তরুণের দাপটে ভাঙতে বসেছিল লিও মেসির যাবতীয় প্রত্যাশা। মাত্র ষাট সেকেন্ড নিলেন কিলিয়ান এমবাপে। আর তাতে আর্জেন্টাইন ডিফেন্সের শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। ফ্রান্স সমতায় ফিরল এমবাপের পেনাল্টি থেকে। আর দ্বিতীয় গোল। এমনটা বিশ্বকাপের ফাইনালেই হয়ে থাকে।
তবে মেক্সিকো সিটির সঙ্গে কাতার ফারাক গড়ে দিল অনেক জায়গাতেই। পঁচাশি মিনিটে জর্জে বুরুচাগা গোল করে আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ জিতিয়েছিলেন। সেই ফাইনালে মারাদোনার কোনও গোল ছিল না। কিন্তু লুসাইলে জোড়া গোল করে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে ডেডলক ভাঙলেন লিও মেসি। ম্যাচের বয়স তখন ১০৮ মিনিট। এর মধ্যে দু দলই অনেক পরিবর্তন ঘটিয়েছে। হয়তো আর্জেন্টিনার প্রথম সারির দৈনিকের প্রথম পাতায় বিশ্ব জয়ের রূপগাথা লেখাও হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কে জানত তখনও এমবাপে নামের ফরাসি তরুণের ছোবল বাকি আছে ?
বিশ্বকাপের ফাইনাল ৫৬ বছর আগে হ্যাটট্রিক করার কৃতিত্ব ছিল এক ইংরেজের। তাঁর নাম জিওফ হার্স্ট। সেই কীর্তি ছুঁয়েও এমবাপে ম্লান হলে মেসির জাদুর কাছে। নব্বই মিনিটে ফল ২-২। অতিরিক্ত সময়। ৩৫ বছরের মেসি পারবেন তো ১২০ মিনিট পর্যন্ত লড়াই দিতে ? এই প্রশ্ন খানিকক্ষণের জন্য ঘুরপাক খেল। প্রবাদে আছে, বাঘ বুড়ো হলেও বাঘ। তাই ৩৫ তাঁর কাছে সংখ্যা মাত্র। ফাইনালের আগে যাঁর হ্যামস্ট্রিংয়ে চোট নিয়ে এত আলোচনা, সেই মেসি দেখিয়ে দিলেন তাঁর ফিটনেটের রহস্য।
সৌদি আরবের বিরুদ্ধে এই লুসাইলে পেনাল্টি থেকে গোল করে বিশ্বকাপ শুরু করেছিলেন। আর সেই লুসাইলে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে টাইব্রেকারে গোল করে বৃত্ত সম্পন্ন করলেন। তাঁর মঞ্চেই ফ্রান্সের কফিনে শেষ দুটি পেরেক ঠুকলেন এমি মার্টিনেজ এবং গঞ্জালো মন্ট্রিয়াল। ৩৬ বছর পর শাপমুক্তি। আগামী চার বছরের জন্য বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা। কাজানের দেনা শোধ করে স্বপ্নের ম্যাচে মেসি হয়ে থাকলেন বাস্তব।