সংখ্যা নিয়ে মানুষের উৎসাহের শেষ নেই! জোড়-বিজোড় থেকে মৌলিক-যৌগিক। সংখ্যাকে নিয়ে নানা প্রশ্ন এবং সেই সংক্রান্ত বিস্ময় মানুষকে আকৃষ্ট করে রেখেছে গণিতের ইতিহাসের শুরুর দিনগুলো থেকেই। যেমন বিস্ময়ের শেষ নেই অসীম নিয়েও। কোন সংখ্যা অসীম? কোন সংখ্যাই বা অসংজ্ঞাত? তবে, এই সব আলোচনাকেই অতিক্রম করে গিয়েছে বৃহত্তম মৌলিক সংখ্যার অন্বেষণ! অর্থাৎ, সবচেয়ে বড় মৌলিক বলে এমন একটা সংখ্যা থাকবে, যার পরে আর কোনও মৌলিকের দেখা মিলবে না।
যিশু খ্রিস্টের জন্মের ৩০০ বছরেরও বেশি আগে গ্রিক গণিতজ্ঞ ইউক্লিড প্রমাণ করেছিলেন যে, ওই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। সামান্য যুক্তিতর্কে ওই ধারণা ভেঙে দিয়েছিলেন তিনি। যৎসামান্য যুক্তিতে প্রকাণ্ড এক সত্য প্রতিষ্ঠার উদাহরণ অঙ্কশাস্ত্রে আর বেশি নেই। যুক্তি এত জলবৎ তরলং যে, সবাই বুঝবে।
বোঝানো যাক। ধরা যাক, ২, ৩, ৫, ৭, ১১ এবং ১৩-র পরে আর কোনও মৌলিক সংখ্যা নেই। ১৩ সবচেয়ে বড় মৌলিক। এমনটা মেনে নিলে কী হয়, তা দেখা যাক। ইউক্লিড যা বললেন, তা ওই উদাহরণে প্রয়োগ করলে একটা সংখ্যায় পৌঁছনো যায়। সংখ্যাটা হল ২x৩x৫x৭x১১x১৩+১= ৩০০৩০+১=৩০০৩১। এই সংখ্যাটা কি মৌলিক? ১৩ সবচেয়ে বড় মৌলিক হলে, ৩০০৩১ আর কেন মৌলিক হবে? অথচ, যে পদ্ধতিতে তৈরি হল ৩০০৩১, তা থেকে বোঝা যাচ্ছে, ৩০০৩১ কোনও মৌলিকের গুণিতক নয়। ৩০০৩১-কে ২, ৩, ৫, ৭, ১১ বা ১৩ দিয়ে ভাগ করলে সব সময় ভাগশেষ থাকবে ১ (কারণ, ৩০০৩০ যে ২, ৩, ৫, ৭, ১১ এবং ১৩-র গুণফল)। সুতরাং, দেখা গেল, যতগুলো সংখ্যা মৌলিক বলে দাবি করা হয়েছিল, তাদের মোট গুণফলের সঙ্গে ১ যোগ করলে নতুন একটা মৌলিক পাওয়া যায়। তা হলে তো ১৩ সবচেয়ে বড় মৌলিক নয়। সে রকম দাবি করা ভুল। কোনও সংখ্যাকেই সবচেয়ে বড় মৌলিক দাবি করা ভুল।
ইংল্যান্ডের পোর্টসমাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতবিদ টমাস কেকার বলেন, 'মৌলিক সংখ্যা হল গণিতের সংখ্যা তত্ত্বের 'পরমাণু'।
বাস্তব পরমাণু এবং মৌলিক সংখ্যার মধ্যে একটি প্রধান পার্থক্য হল বিভিন্ন ধরণের স্থিতিশীল পরমাণুর সংখ্যা সসীম। অপরদিকে, প্রাচীন গ্রীসে ইউক্লিডের সময় থেকেই জানা যায় যে, মৌলিক সংখ্যার অসীমতা আছে। ঠিক এই জায়গা থেকেই শুরু হয়েছিল বৃহত্তম মৌলিক সংখ্যার অন্বেষণ!
মৌলিক পরিমাণ ২-এর গুণফল থেকে ১ বাদ দিয়ে যে সব সংখ্যা মেলে, সেগুলোর মধ্যে কোনটা নিজে মৌলিক, তা খুঁজে চলেছেন কুপার এবং তাঁর বন্ধুরা। ২০১৩ সালের ২৫ জানুয়ারি ওঁরা ঘোষণা করেছিলেন ৫,৭৮,৮৫,১৬১টি ২-এর গুণফল থেকে ১ বাদ দিলে যে সংখ্যা দাঁড়ায়, তা মৌলিক। তখন পর্যন্ত ওটাই ছিল সবচেয়ে বড় মৌলিক।
তারপর কুপার এবং তাঁর বন্ধুরা জানালেন, ৭,৪২,০৭,২৮১-টা ২-এর গুণফল থেকে ১ বাদ দিলে যে সংখ্যা মেলে, তাও এক মৌলিক। সে সংখ্যাটা কত? তা লেখা যাবে না। শুধু জানানো যাক, ওতে অঙ্ক রয়েছে মোট ২,২৩,৩৮,৬১৮-টা! সেই রেকর্ড ভাঙল তারপর। জানা গেল, সবথেকে বড় মৌলিক সংখ্যা হল ১৩৬,২৭৯,৮৪১-টা ২-এর গুণফল থেকে ১ বাদ দিলে যে সংখ্যাটা দাঁড়ায়, সেটিও মৌলিক!
এই দুই মৌলিক সংখ্যাই আসলে মারসেন প্রাইম। ফরাসী সন্ন্যাসী মেরিন মারসেনের নামে নামকরণ করা হয়েছিল যে সংখ্যার। যিনি ৩৫০ বছরেরও বেশি আগে এই সংখ্যাগুলি নিয়ে কাজ করতে শুরু করেছিলেন তিনি।
নতুন বৃহত্তম মৌলিক সংখ্যাটির আবিষ্কারক লুক ডুরান্ট। এই মৌলিক সংখ্যা খুঁজে পাওয়ায় ডুরান্টকে ৩ লাখ মার্কিন ডলার পুরস্কার দেওয়া হয়েছে।
দেখতে সহজ মনে হলেও সংখ্যাটা বিশাল বড়। নতুন এই মৌলিক সংখ্যায় ৪ কোটি ১০ লাখ ২৪ হাজার ৩২০টি অঙ্ক (ডিজিট) আছে। এমন সংখ্যা খুঁজে বের করাও কঠিন! কম্পিউটার ছাড়া তো সম্ভবই নয়। ডুরান্ট এই সংখ্যা খুঁজে পেয়েছেন গ্রেট ইন্টারনেট মার্সেন প্রাইম সার্চ বা গিম্পস (GIMPS)-এর সাহায্যে।
উল্লেখ্য, গিম্পস একটা কম্পিউটিং প্রজেক্ট সফটওয়্যার।