‘হঠাৎ তাসের দেশে এল, ‘অবাধ্যতা’র ঢেউ’।
বাংলা গানের এই কলির মতোই, ‘তাসের দেশ’ ইরানে অবাধ্য হয়েছিলেন আহু, মাহসা , বায়েগানরা। কিন্তু ইরানে এই ‘অবাধ্যতা’র কোনও ক্ষমা নেই। রয়েছে শাস্তি, কঠোরতম শাস্তি। ইরানে জারি রয়েছে মহিলাদের জন্য কঠোর পোশাক বিধি। হিজাব ছাড়া রাস্তাঘাটে বেরোবে মেয়েরা? নৈব নৈব চ। শুধু তাই নয়, পোশাক কেমন হবে, শরীর ঢাকা থাকবে কতটা, চুল খোলা থাকবে না বাঁধা- সব নিয়েই নিয়ম বাঁধা রয়েছে ইরানে।
২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে, ‘হিজাব ও শুদ্ধতার সংস্কৃতির পক্ষে সমর্থন’ নামে একটি বিল পাশ হয় ইরানে। তিন বছর ওই বিল পরীক্ষামূলক প্রয়োগের পর, ‘গার্ডিয়ান কাউন্সিল’ থেকে অনুমোদন পেলে ওই বিল দেশের আইনে পরিণত হওয়ার কথা। বলা ছিল, এই আইন অমান্য করলে মহিলার ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড অবধি হতে পারে। শুধু তাই কেন? মৃত্যুও হতে পারে ওই মহিলার, হয়ে যেতে পারেন নিখোঁজও।
এই ‘অচলায়তন’ ভাঙতে গিয়েছিলেন আহু দরিয়াই। প্রথমে আর ৫ জনের মতো হিজাব পরেই বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতেন দরিয়াই। অভিযোগ, এরপরেও তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে বাসিজ আধাসামরিক বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা হয়রানির শিকার হতে হয়। তাঁর হিজাব ও পোশাক ছিঁড়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। টান দেওয়া হয়েছিল মেয়েটির ঊর্ধ্বাঙ্গের পোশাকেও। প্রতিবাদে নিজের পোশাক খুলে ফেলেন দরিয়াই, অন্তর্বাস পরে তিনি হেঁটে বেড়ান বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে।
চারিপাশ হিজাবে ঢাকা মেয়েদের মাঝে গায়ে ডোরা কাটা বেগুনি অন্তর্বাস। সাদা কালো পৃথিবীতে একমাত্র রঙিন, দ্যুতিময়, উজ্জ্বল! ক্যম্পাস জুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে খামখেয়ালি জেব্রা সুন্দরী। সেই ছবি এখন দাপিয়ে ঘুরছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। তাঁর এই অবাধ বিচরণ মেনে নেয়নি ইরান সরকার। তড়িঘড়ি তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মানসিক ভারসাম্যহীন তকমাও জুটেছে তাঁর। ফেসবুকে, ট্যুইটারে ফের আওয়াজ উঠেছে। কিন্তু কেউ জানে না, তারপর থেকে দরিয়াই কোথায়!
অবাধ্যতার ‘সাজা’
ইরানে এমন মেয়ে নিখোঁজ হয়েছেন আগেও। নইলে তাঁদের ঠাঁই হয় মানসিক হাসপাতালে। দরিয়াই-ও কি ‘হিজাব’ এর বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলে ‘পাগল’ই প্রতিপন্ন হলেন?
২০২২ -এর সেপ্টেম্বর মাস। হিজাব না পরে রাস্তায় বেরনোর 'অপরাধে' পুলিশ তুলে নিয়ে গিয়েছিল ইরানি তরুণী মাহসা আমিনিকে। গ্রেফতার হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পুলিশি হেফাজতে মৃত্যু হয় তাঁর। আগুন জ্বলে উঠেছিল বিশ্ব জুড়ে, মহিলারা পুড়িয়ে ফেলেছিলেন হিজাব। সর্বসমক্ষে কেটেছিলেন চুল। কিন্তু ঘটনার দুবছর পরেও ইরানি প্রশাসনের ‘অনুতাপ’ নেই।
ইরানের অভিনেত্রী, আফসানেহ বায়েগান। ৬১ বছরের এই শিল্পীকে দুবছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। ‘অ্যান্টি ফ্য়ামিলি পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার’ ভুগছেন তিনি এই বলে তাঁকে পাঠানো হয়েছিল মানসিক হাসপাতালে। দোষ বলতে, ইনস্টাগ্রামে খোলা চুলের ছবি পোস্ট করেছিলেন তিনি, হিজাব ছাড়াই গিয়েছিলেন অনুষ্ঠানে। তবে এই ঘটনা বিচ্ছিন্ন কোনও ঘটনা নয়। অভিনেত্রী, নায়িকা, শিল্পী, গায়িকা সকলের জন্যই নিয়ম এক। ইরানের আরও এক অভিনেত্রী, আজাদেহ সামাদি। কোনও এক শেষ কৃত্যে তিনি হিজাবের বদলে টুপি পরেছিলেন বলে প্রশাসন তাঁকেও মানসিক রোগী বলে দাগিয়ে দিয়েছিল।
শুধু মহিলারাই নয়, রেহাই নেই শিশুদেরও। বিধি না মানলে মোটা টাকা জরিমানা, হিজাব ছাড়া মেয়েরা গাড়ি চালালেও তাঁদের ফোনে ঢুকছে হুমকি মেসেজ,বাজেয়াপ্ত করা হচ্ছে গাড়ি, হাসপাতালে চিকিৎসা পর্যন্ত না দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে, যে দোকান তাঁদের খাবার বিক্রি করছে সেই দোকান পর্যন্ত বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে।
ইরানের মতো দেশে বসে, এই প্রতিবাদের জন্য বুকে যে পরিমাণ সাহস সঞ্চয় করার দরকার পড়ে— তা মাপার মতো একক নেই। এইসব নিয়ম মেনে যাঁরা চলেছেন তাঁদের আমরা চিনি না, যাঁরা ভেঙেছেন বা ভাঙতে চেয়েছেন তাঁদের আর খোঁজ পাওয়া যায়নি।
নারী স্বাধীনতা ‘সোনার পাথরবাটি’
তথ্য বলছে, এই কঠোর আইন ইরানে মেয়েদের অবসাদ, উদ্বেগ, আত্মহত্যা সহ মানসিক অসুখের কারণ হচ্ছে। হতাশা ক্রমেই গ্রাস করছে তাঁদের। সেখানে নিষিদ্ধ গর্ভনিরোধ। সমকামি প্রেমের শাস্তি কারাদণ্ড বা মৃত্যদণ্ড।
কবে ইরানের মেয়েরা, ‘স্বাধীনতা’র আলো দেখবে জানা নেই। স্বৈরাচারী সরকারের ব্রেনম্যাপের বিরুদ্ধে যাঁরা লড়ছেন, তা একরকম জিহাদি। যে জিহাদির চোখে জন্নতে গিয়ে হুর-পরির সঙ্গে জীবন কাটানোর স্বপ্ন নেই। দেশটাকে আরও একটু ‘বাসযোগ্য’ করে যেতে চাইলেন যাঁরা, দেশ তাঁদের বুঝবে কবে? প্রশ্ন উঠছে বিশ্বজুড়ে।