Gaza War : পড়ে আছে একের পর এক মৃতদেহ, ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন যুদ্ধের নেপথ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ইতিহাস

Updated : Oct 22, 2024 12:25
|
Editorji News Desk

'গাজা'। দুই অক্ষরের শব্দ। অ্যাফ্রো-এশিয়াটিক ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্গত প্রাচীন সেমিটিক ভাষায় যার অর্থ 'ক্রুদ্ধ, শক্তিশালী'। খ্রীষ্টপূর্বাব্দ পঞ্চদশ শতকে প্রতিষ্ঠিত এই চিলতে ভূখণ্ড ঘিরে বহু রক্তাক্ত টানাপড়েনের সাক্ষী থেকেছে গোটা বিশ্ব যুগের পর যুগ ধরেই। পাঁচ হাজারের বছরেরও বেশি বয়সী বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন শহরটির আয়তন মোটামুটি ৪৫ বর্গ কিলোমিটার। অর্থাৎ, মূল কলকাতা ভূখণ্ডের পাঁচ ভাগেরও এক ভাগ। মধ্যপ্রাচ্যের এই একরত্তি অঞ্চলকে কেন্দ্র করে যে সংঘর্ষের সূত্রপাত, তা এমনকি আরব দুনিয়ার দেশগুলির মধ্যে পারস্পরিক যুদ্ধের যে রক্তক্ষয়ী ইতিহাস, তার নিরিখেও নজিরবিহীন।

তবে, এই যুদ্ধের ইতিহাস খুব নতুন নয়। ইজরায়েল এবং প্যালেস্তাইনের জঙ্গিগোষ্ঠী হামাসের মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে থেকেই চলছে সংঘাত। যার মূলে রয়েছে, আরবদের সঙ্গে ইহুদিদের ঐতিহাসিকভাবেই জাতিগত শত্রুতার বীজ। বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টেও যার উল্লেখ রয়েছে। তবে, আধুনিক যুগে আরব ও ইহুদিদের সংঘাত শুরু হয়েছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আশেপাশের সময় থেকে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ সরকারের পাশে ছিল ইহুদি সম্প্রদায়। বিপুল অর্থ দিয়েও সাহায্য করেছিল। এর বদলে ইহুদি জায়োনিস্ট নেতারা তাঁদের আদিভূমির দাবি জানিয়েছিলেন। ১৯১৭ সালে ব্রিটেনের বিদেশ সচিব আর্থার ব্যালফুর ব্রিটিশ ইহুদি নেতা লর্ড রথসচাইল্ডের কাছে এক পত্র দ্বারা সেই সময়ে ওটোমান সাম্রাজ্যের হাত থেকে ইজরায়েল উদ্ধার সম্ভব হলে তা ব্রিটেন ও আয়ারল্যান্ডের জায়োনিস্ট ফেডারেশনের হাতে তুলে দেওয়ার কথা বলেন। 

ব্যালফুরের এই আশ্বাসকে ‘ঘোষণাপত্র’ হিসেবে ইহুদিরা গণ্য করে যুদ্ধ শেষ হলে সেখানে বসতি স্থাপন করার প্রক্রিয়া শুরু করেছিল।

১৯১৮ সালে ইহুদিদের একটি বাহিনী ব্রিটিশ সেনাদের প্যালেস্তাইন দখলে সহায়তা করে। বিভিন্ন দেশ থেকে ইহুদিরা ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন অঞ্চলে আসতে শুরু করেন। স্বাভাবিকভাবেই ওই অঞ্চলের আরবেরা বিষয়টিকে ভাল চোখে দেখেননি। সেই সুবাদেই শুরু হয় ইহুদিদের সঙ্গে তাঁদের দাঙ্গা। এর নেপথ্যে একটি 'ভূমিকা' ছিল ব্যালফুর সেই ঐতিহাসিক ঘোষণাপত্রেরও। সেখানে আরবদের প্যালেস্তাইন দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও ছিল।  ফলে আরব ও ইহুদিদের সংঘাত অনিবার্য হয়ে পড়ে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বেশ খানিকটা আগে থেকেই জার্মানিতে হিটলারের শাসন কায়েম হওয়ার পর শঙ্কিত ও বিধ্বস্ত ধনী ইহুদিরা সেই দেশ থেকে পালিয়ে আসতে থাকেন তাঁদের 'আদিভূমি' হিসেবে কথিত প্যালেস্তাইনে। এই সময় ভয়াবহ আকার নিয়েছিল প্যালেস্তিনীয় আরব ও ইজরায়েলপন্থী ইহুদিদের মধ্যে সংঘর্ষ। দু'পক্ষেরই কয়েক হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল সেই রক্তক্ষয়ী সংঘাতের ফলে। পরিস্থিতিকে 'নিয়ন্ত্রণে' আনতে ফের আসরে নেমেছিল তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার। তারা জানায়, ১৯৪৮ সালে প্যালেস্তাইনকে ব্রিটিশ শাসনমুক্ত করা হবে। তবে, তার আগে এই এলাকার ভাগ হওয়া দরকার। রাষ্ট্রপুঞ্জে সেই প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল। সেই প্রস্তাবের ফলেই প্যালেস্তাইনকে আরব ও ইহুদিদের জন্য পৃথক দুটি ভাগে ভাগ করে দেওয়া হয়েছিল। এই ভাগাভাগি মানতে পারেনি একক রাষ্ট্র হতে চাওয়া প্যালেস্তাইন। রাষ্ট্রপুঞ্জে এই নিয়ে সরাসরি বিরোধিতা করে তারা। যার ফলে শুরু হয় চরমপন্থী বিদ্রোহ। তারপর একের পর এক যুদ্ধ। যার সরাসরি প্রভাব পড়ে সমগ্র প্যালেস্তাইনের মানচিত্রে। ১৯১৭ সালে গোটা দেশের মানচিত্র যা ছিল, ৪০ বছরে তা কমতে কমতে এসে ঠেকেছে দু’টি ছোট্ট টুকরোয়। এক ভাগের নাম ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক। অন্য ভাগটির নাম গাজা স্ট্রিপ। ১৯৬৭ সালে মাত্র ৬ দিনের যুদ্ধে গোটা প্যালেস্তাইনের দখল নিয়ে নিয়েছিল ইজরায়েল। ১৯৯৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় অসলো চুক্তির মাধ্যমে ইয়াসের আরাফতের পিএলও এবং ইজরায়েল একটি সমঝোতায় এসেছিল। কিন্তু, ২০০৬ সালে প্যালেস্তাইনের সংসদীয় নির্বাচনে হামাসের জয়লাভের পর থেকে ২০০৭ সাল থেকেই ফের সব হিসেব গুলিয়ে যাওয়ার শুরু। ফের, আরও একবার যুদ্ধের আঁধার এসে হামলে পড়ল ভূমধ্যসাগরের একপ্রান্তের এই ভূখণ্ডে।

যার বলি হয়েছেন সাধারণ মানুষ। সদ্যজাত থেকে অতি বৃদ্ধ পর্যন্ত সকলেই। যুগের পর যুগ ধরে। ঠিক কত সংখ্যক মানুষের এই সংঘর্ষ বা যুদ্ধের ফলে প্রাণহানি হল, তার ঠিকঠাক হিসেব কারও কাছেই নেই। ঠিক যেমন হিসেব নেই, শুধু প্রাণই নয়, আরও কতভাবে চিরকালীন ক্ষতির মুখে পড়লেন অগণিত সংখ্যক মানুষ। যুদ্ধ তো শুধু প্রাণই কাড়ে না। কার্যত, মানুষের জীবনের নানা অস্তিত্বই চিরকালের মতো টালমাটাল হয়ে পড়ে। ঘুণ ধরিয়ে দেয় বহু প্রচলিত চিন্তাভাবনায়। মনে ফেলে সুদূরপ্রসারী প্রভাব। ওটিটি প্ল্যাটফর্ম 'নেটফ্লিক্স'-এ একটি তথ্যচিত্র রয়েছে। যার নাম- 'বর্ন ইন গাজা'। যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজার কয়েকজন কিশোরের বর্তমান জীবনকে কেন্দ্র করে তৈরি এই তথ্যচিত্রে উঠে এসেছিল ঠিক কীভাবে তপতপে কৈশোর-মনে ভয়াবহ ছাপ ফেলে যায় যুদ্ধ। কেউ পা হারিয়েছে, কেউ হারিয়েছে হাত, কারও সম্পূর্ণ দৃষ্টি চলে গিয়েছে চিরকালের মতো। এর পাশাপাশিই রয়েছে শরীরে বহু মারণ রোগের প্রভাবও। গবেষণার খাতিরে ব্যবহৃত সাল-তারিখ বা সংখ্যাতত্ত্বের ইতিহাসের নিজস্ব জৌলুস থাকলেও, আসলে তো তাকে শেষমেশ বারবারই ছাপিয়ে যায় মানুষের ইতিহাস। সেই ইতিহাসই আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে যে, কে আগে আক্রমণ করেছে, কার প্রতিআক্রমণ আসলে আত্মরক্ষা- এই সব তর্ক পেরিয়ে যে কোনও যুদ্ধ বা সামরিক অভিযানের রণনীতি-কূটনীতির সমান্তরালে ঘটে চলে, ঘটেই চলে কেবলমাত্র সাধারণ মানুষের মৃত্যুমিছিল। যে মৃত্যু মিছিলের প্রধান বলি আক্রান্ত ভূখণ্ডের নারী ও শিশুরা। যুদ্ধে ঠিক কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয় সংখ্যাতীত শিশু ও নারীরা, তা নিয়ে রেড ক্রসের রিপোর্টও, রাষ্ট্রপুঞ্জের বার্তাও ছবিটা আসলে বদলাতেই পারে না কখনও। আর,  ঠিক এই বিন্দুতেই মিলে যায় মধ্যপ্রাচ্যের গাজার সাধারণ মানুষ থেকে দক্ষিণ এশিয়ার রোহিঙ্গা উপজাতি। এক হয়ে যায় পশ্চিম আফ্রিকার গৃহযুদ্ধে আক্রান্ত অতি দরিদ্র দেশ থেকে ইউরোপের ইউক্রেন।

যে শিশুরা মারা গেল তারা যুদ্ধে যায়নি। কঠিন সত্যটা হল- যুদ্ধের ফলে মৃত্যু হওয়া সিংহভাগ মানুষই আসলে কখনও যুদ্ধে যান না। যুদ্ধ অনেক সময়ই শিশুদের ব্যবহার করে, কখনও সহায়কের ভূমিকায়, কখনও টোপ হিসাবে। তাতেও তাদের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ শিকার হিসাবে শিশুমৃত্যুর মর্মন্তুদ অনুসন্ধান করেছেন দেশ-বিদেশের বহু গবেষক এবং ইতিহাসবিদ। গাজার যে ইতিহাস প্রতিদিন নতুনভাবে লেখা হয়ে চলেছে বর্তমান সময়ের প্রচারমাধ্যম এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মানবাধিকার ও ত্রাণ সংস্থাগুলির বয়ানে, তাকে শুধু যুদ্ধের তাৎক্ষণিক বীভৎসতার একমাত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে ভুল হবে। তা আসলে, গোটা মানবসভ্যতারই এক বহুদূরপ্রসারী ক্ষতির ইতিহাস। সেখানে লেখা থাকছে গুঁড়িয়ে যাওয়া শহরের তলায়, ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়ে থাকা শিশুদের কথা, যাদের উদ্ধারও করা যাচ্ছে না। লেখা থাকছে নিখোঁজ শিশুদের কথা যুদ্ধের জন্য খেতে না-পাওয়া, চূড়ান্ত অপুষ্টিতে ভোগা টিমটিম করে কোনওভাবে বেঁচে থাকা শিশুদের কথা। যুদ্ধে ভেঙে গুঁড়িয়ে গিয়েছে হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র। তার মধ্যেই কোনওভাবে টিকে থাকা কয়েকটি ওয়ার্ড যুদ্ধ আক্রান্ত এমন বহু শিশুতে ভরে যাওয়া সত্ত্বেও গোটা হাসপাতাল শব্দহীন- কারণ, চিৎকার করে কাঁদতে হলেও যেটুকু স্নায়বিক শক্তির প্রয়োজন, এই শিশুদের সেটুকুও নেই, যুদ্ধজনিত 'আঘাত' চিরকালের মতো কেড়ে নিয়েছে তাদের বাকশক্তি। এই যুদ্ধের হাত ধরেই ছায়ার মতো এসে উপস্থিত হয় অনাহার ও দুর্ভিক্ষ। যার ফলে ঠিক কত হাজার বা লক্ষ প্রাণ যে মিলিয়ে যায়, তার যথাযথ পরিসংখ্যান কোনও রেড ক্রস বা রাষ্ট্রপুঞ্জের কাছেও নেই।

২০২৪ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছে জাপানের সংগঠন নিহন হিদানকায়ো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে হিরোশিমা-নাগাসাকির পারমাণবিক বিস্ফোরণে বেঁচে গিয়েছিলেন যে কতিপয় মানুষেরা, তাঁদেরই কয়েকজন গড়ে তুলেছিলেন এই সংগঠন। নোবেল পুরস্কারের ঘোষণার পর সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে এই সংগঠনের প্রধান তোশিউকি মিমাকি, যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজার কথা বলতে গিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, গাজার বর্তমান অবস্থা দেখে তাঁর মনে পড়ে ৮০ বছর আগের হিরোশিমা-নাগাসাকি পরবর্তী জাপানের কথা। এই মুহূর্তে যাঁরা যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায় মানবতার জন্য প্রাণপণে লড়াই চালাচ্ছেন, তাঁরাই আসলে নোবেল শান্তি পুরস্কারের 'উপযুক্ত' দাবিদার।

যুদ্ধ আসে। যুদ্ধ যায়। নানা ধ্বংস ও মৃত্যুর মধ্যেই শেষমেশ যা থেকে যায় আসলে, তা হল ক্ষমতার লোভে মানুষের হেরে যাওয়ার গল্পই। মানুষের ক্রমে মানবতার শেষতম বিন্দুটি থেকেও দূরে সরে যাওয়ার গল্প। তবে, মানুষের মৃত্যু হলে তবুও তো মানব থেকে যায়। সেই জায়গা থেকেই আমাদের চোখে ধরা পড়ে নানা জীবনের ছবি। যা নানা লড়াইয়ের পরও তবু হেরে যায় না। যা টিকে থাকে। যা বেঁচে থাকতে চায়। লড়াইতে থাকতে চায়। জীবনেরই স্বার্থে। জীবনেরই পাশে।

Israel

Recommended For You

editorji | বিদেশ

Bangladesh : কলকাতা কি দখল সম্ভব? সামরিক শক্তিতে কতটা এগিয়ে বাংলাদেশ

editorji | বিদেশ

Syria Crisis: যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ায় দায়িত্ব নিল অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, ৭৫ ভারতীয়কে দেশে ফেরাল ভারত

editorji | বিদেশ

Bangladesh News : ভারতের চাপে নতিস্বীকার, সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচারের ঘটনায় ঢাকায় গ্রেফতার ৭০

editorji | বিদেশ

Bangladesh News : চলবে না হাসিনাকে সমর্থন, দিল্লিকে শর্ত দিয়ে বন্ধুত্ব বাংলাদেশের

editorji | বিদেশ

Bangladesh Crisis : বাংলাদেশে হিন্দুরা নিরাপদ নয়, ঢাকার বৈঠকে দাবি ভারতের, BNP নেতাকে জবাব মমতার