'বিচার যত পিছোবে, লড়াই ততো এগোবে'। আরজি করের ঘটনায় পথে পথে মিছিলে প্রতিবাদে এই স্লোগান এখন দারুণ জনপ্রিয়। আরজি কর হাসপাতালে ডিউটিরত মহিলা চিকিৎসকের ধর্ষণ এবং মৃত্যুর ঘটনায় এক মাস পেরলো, বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ-প্রতিবাদ-আন্দোলনের ঢেউ কি শান্ত হয়ে আসছে? একেবারেই না, বরং বলা যায় 'ঢেউ উঠছে-কারা টুটছে'। বাংলা তথা গোটা দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশের মাটিতে জোরালো হচ্ছে প্রতিবাদ। বিচার যতো পিছোচ্ছে, আক্ষরিক অর্থেই আরও লম্বা হচ্ছে প্রতিবাদ।
আমেরিকা, কানাডা, পোল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, তাইওয়ান, কোথায় প্রতিবাদ নেই? কোথায় বিচার চেয়ে স্লোগান তুলছে না মানুষ। কোনও জমায়েতে প্রতিবাদী সুর , কোথাও আবার মৌন মিছিল, কোথাও আঁধার ভেদ করে জ্বলে উঠছে হাজার প্রদীপ। কেউ কর্মসূত্রে প্রবাসে, কেউ উচ্চশিক্ষার জন্য প্রবাসে। কেউ বা পাকাপাকিই থাকেন কলকাতার আরজি কর থেকে হাজার হাজার মাইল দূরের এক দেশে। অত দূরে কীভাবে পৌঁছে গেল প্রতিবাদের আঁচ? সব বয়সের, সব শ্রেণির সব পেশার মানুষের মুখে আরজি করের নারকীয় ঘটনার বিচারের দাবি ক্রমে গণ আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। গণ আন্দোলনের চরিত্র মতোই দেশের সীমানায় আবদ্ধ থাকেনি সেই আন্দোলন।
বিদেশের মাটিতেও প্রতিবাদে শামিল কচি কচি বাচ্চারা। কত বয়স? কয়েক বছর, কয়েক মাসও। হাঁটতে শেখেনি, কথা ফোটেনি, অথচ প্যারামবুলেটরে লেখা 'where ever I go, However I dress, No means No, Yes means Yes'. দুধের দাঁত পড়ার আগে ওরা শিখে নিচ্ছে বিশ্বজুড়েই লড়াই পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে'। জেনে নিচ্ছে, কখনও কখনও কারোর ব্যক্তিগত লড়াই হয়ে ওঠে গোটা একটা সমাজের দাবি।
সমাজ বিশ্লেষকদের অনেকের মত, আরজি করের ঘটনা আসলে শুধুই ধর্ষণ কিমবা খুনের ঘটনা নয়, একই সঙ্গে নারী নিরাপত্তা, প্রসাশনিক ব্যর্থতা, সরকারি হাসপাতালে পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতির বিষয়গুলি সামনে নিয়ে এসেছে। তাছাড়া পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় লিঙ্গসাম্য শব্দটা এখনও অভিধানেই রয়েছে। সাম্যের অধিকারের জন্য মেয়েদের এবং প্রান্তিক যৌনতার মানুষদের লড়াইয়ের পথ এখনও মসৃণ নয়। মহিলা এবং এলজিবিটিকিউ সম্প্রদায়ের মানুষকে এখনও যৌন হেনস্থার শিকার হতে হয় প্রায় নিয়মিত। কোনও ঘটনা সামনে আসে, কোনওটা চাপা পড়ে যায়। এ সব কত চাপা পড়ে যাওয়া ঘটনায় তৈরি হওয়া ক্ষত থেকেই তিলোত্তমার আওয়াজ হয়ে উঠছেন মিছিলে আসা মানুষেরা। তাঁদের চিৎকারে বেরিয়ে আসছে কত বছরের জমিয়ে রাখা কান্না, যন্ত্রণা। তাই এই প্রতিবাদ সংগঠিতর চেয়ে অনেক বেশি স্বতঃস্ফূর্ত। আর, দেশ ভাল নেই, দেশের মানুষ ভাল নেই, জানতে পারলে প্রবাসে ভাল থাকা যায়? রাতে ঘুম আসে? আসেনা তো। এক এবং একমাত্র দাবি হয়ে ওঠে ন্যায়বিচার। তাই তিলোত্তমার সোদপুরের বাড়ি থেকে, আরজি কর হাসপাতাল থেকে ফ্রান্স, জার্মানি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূরত্ব পেরিয়ে ওরা জানান দিয়ে যায় হাতে হাত রাখাই আছে, মুঠো আরও শক্ত হয় সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে।