'নম্বর'! তিন অক্ষরের এই শব্দ দুনিয়ার কোনও বয়সের কোনও পড়ুয়াকে 'শান্তি' দেয় না! স্কুলজীবন থেকে উচ্চশিক্ষা- সব ক্ষেত্রের পড়ুয়ারই নানা ধরনের নম্বর নিয়ে দুশ্চিন্তার শেষ নেই! বিশেষ করে শিশুদের। পরীক্ষার ফল বেরোনোর পর 'কত নম্বর হল' তা নিয়ে জবাবদিহি করতে করতেই প্রাণ কার্যত ওষ্ঠাগত! এবার নম্বরের কারণে রেজাল্ট নিয়ে শিশু ও অভিভাকদের 'মাথাব্যথা' কমানোর এক অভিনব ও কার্যকর উপায় বার করল কেরালার কোচি শহরের কয়েকটি সিবিএসই স্কুল! কোন পড়ুয়া কতটা শিখতে পারল, তার মূল্যায়ন করতে এবার থেকে ইমোজি ব্যবহার করবেন তাঁরা। হাততালি, স্টার, ট্রফির মতো ইমোজি দিয়েই বোঝানো হবে, স্কুলে গিয়ে ওই পড়ুয়া কতটা উন্নতি করতে পারল।
এ বার থেকে লিখিত পরীক্ষার বদলে শিশুদের সারা বছরের কাজকর্ম, স্বাস্থ্য, আচার আচরণ, কথা বলার দক্ষতা ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে মূল্যায়ন করা হবে। চলতি শিক্ষাবর্ষ থেকেই চালু হয়ে গিয়েছে এই সার্বিক মূল্যায়ন পত্র বা ‘হোলিস্টিক রিপোর্ট কার্ড’। চিরাচরিত মূল্যায়ন পদ্ধতির বাইরে গিয়ে এই অভিনব পদ্ধতি শিশুদের আরও উৎসাহ জোগাবে বলে মনে করা হচ্ছে।
শিশুদের বুনিয়াদি শিক্ষা নিয়ে আলোচনার শেষ নেই যেমন। তেমনই এই কথাও স্মর্তব্য যে, ভারতে নানা সরকারি নীতি ও তার ঠিকঠাক প্রণয়নের ব্যবস্থায় গলদ থাকার ফল বহু বছর ধরেই ভুগতে হয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে। তার একদিকে যেমন রয়েছে স্কুলে আসতে না পারা শিশুরা, আর একদিকেই রয়েছে অত্যধিক পড়ার চাপ নিয়ে লড়াই করতে থাকা খুদেদের দলও। নেলসন ম্যান্ডেলার পর্যবেক্ষণ ছিল- সমাজ শিশুদের প্রতি কী আচরণ করে, তার মধ্য দিয়েই সমাজের চেহারা ফুটে ওঠে। কোচির স্কুলগুলির এই পদক্ষেপ প্রকারান্তরে সমর্থন করে প্রবাদপ্রতিম রাষ্ট্রনায়কের এই মন্তব্যকেই।
সপ্তাহখানেক আগেই একটি 'যুগান্তকারী' সিদ্ধান্ত নিয়েছিল নেদারল্যান্ডের একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়। প্রতি পড়ুয়া তাদের নিজেদের গ্রেড কেবল নিজেরাই দেখতে পারবে। অন্য কেউ নয়। এমনকি, তাদের অভিভাবকরাও নয়। পড়ুয়াদের উপর থেকে পারফরম্যান্সের চাপ কমানোর উদ্দেশ্যে স্কুল কর্তৃপক্ষের এই সিদ্ধান্ত বলে জানায় স্কুল।
কোচির সিবিএসই স্কুলে ২০২০ সালের নয়া শিক্ষা নীতি অনুসারে রিপোর্ট কার্ড সংক্রান্ত এই পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।
যদিও, মূলত কিন্ডারগার্ডেন থেকে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ুয়াদের এমন মজার রিপোর্ট কার্ড দেওয়া হচ্ছে। এবং নয়া গাইডলাইন মেনে প্রথাগত লিখিত পরীক্ষার বদলে বিভিন্ন 'অ্যাক্টিভিটি' অনুসারে তাদের মূল্যায়ন করা হচ্ছে। নতুন ব্যবস্থাপনায় এই শিশুদের পঠন-পাঠনের ক্ষেত্রে কমিউনিকেশন স্কিল, শেখার আগ্রহ এবং সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্যরক্ষা ও মানসিক তথা বৌদ্ধিক বিকাশের উপর নজর দেওয়া হচ্ছে।
একটা সময় ছিল, যখন শুধুমাত্র ছাপানো প্রশ্নপত্রের লিখিত উত্তরের নিরিখে সমস্ত শ্রেণির পড়ুয়াদের মূল্যায়ন করা হত। এখন তাতে বদল আনা হয়েছে।
শুধু নম্বরভিত্তিক পঠনপাঠনে একেবারে শৈশব থেকেই অভ্যস্ত হয়ে পড়লে তা যে শুধু মানসিক চাপ বাড়ায়, তা-ই নয়। মনোবিদরা বলেন, সহানুভূতি বা সমানুভূতির মতো স্বাভাবিক মানবিক বৃত্তিগুলিও অনেক সময় শিশুদের মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণে বিকশিত না হওয়ার অন্যতম বড় কারণও নম্বরের এই ইঁদুর-দৌড়। যার ফলে, স্বাভাবিকভাবেই, তাদের মানসিক বিকাশ সঙ্কীর্ণ হইয়া পড়ে। এবং, বৃহত্তর অর্থে সমাজের উপরও প্রভাব ফেলে। নম্বর নিয়ে প্রতিযোগিতায় না গিয়ে ইমোজির মাধ্যমে রিপোর্ট কার্ডে ফলাফল প্রকাশের সিদ্ধান্তটির ঠিক এই জায়গা থেকেই সাধুবাদ প্রাপ্য। যেখানে একজন শিশুও নম্বর কম পাওয়ার জন্য মনমরা হবে না। নিজেকে একা মনে করে বাকিদের থেকে আলাদা হয়ে সরে যাবে না কোনও অন্ধকার কোণে।