তাঁর আমলে রাজ্যে স্লোগান ওঠে ‘কৃষি আমাদের ভিত্তি, শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ’। ২০০৬ সালের ব্রিগেডের মঞ্চে তাঁর মুখ থেকে শোনা সেই স্লোগান আজও রাজ্যের বামমমনস্ক তরুণ প্রজন্মের মুখে মুখে ফেরে। সুকান্ত ভট্টাচার্যের ভাইপো বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। ২০০৬ সালে রাজ্যে দ্বিতীয়বারের জন্য মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর বুদ্ধবাবু চেয়েছিলেন বাংলায় নতুন শিল্প আনতে, সেইমতো নন্দীগ্রামে কেমিক্যাল হাব, সিঁঙ্গুরে এক লাখি গাড়ি আনার কথা ঘোষণা করে তৎকালীন বাম সরকার। কিন্তু জমি অধিগ্রহণকে কেন্দ্র করে আন্দোলনের জেরে ১৪ মার্চ কৃষকদের উপর গুলি চালনার ঘটনার পর পিছ পা হয় বাম সরকার। মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসেই সেসময়ে বুদ্ধবাবু স্বীকার করে নেন, ‘গুলি চালানো ভুল হয়েছিল’। মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসে এহেন ভুল স্বীকারও তাঁকে ব্যতিক্রম করে রাখে। এরপর তৎকালীন বিরোধী দল তৃণমূল কংগ্রেসের লাগাতার আন্দোলনের জেরে ভেস্তে যায় নন্দীগ্রামের কেমিক্যাল হাব প্রজেক্ট, এবং সিঙ্গুরে টাটার প্রজেক্টও। বুদ্ধবাবু শিল্প আনতে চেয়েছিলেন কিন্তু পারেননি, সেই দুঃখ আজীবন তাঁর মনে রয়ে গিয়েছিল।
সশরীরে তিনি আলিমমুদ্দিন যেতে পারতেন না অনেকদিনই, কিন্তু তাঁর শিক্ষা, ভাবধারা, আদর্শ সবই তরুণ ব্রিগেডের অক্সিজেন। ঘোর বিরোধীরাও তাঁর ব্যক্তিত্বের, সততার, সাদামাটা জীবনের প্ৰশংসক। ২০১১ সালের পর থেকে রাজনীতি থেকে কার্যত তিনি সন্ন্যাস নিলেও এই প্রজন্মের সৃজন, প্রতীকউর, মীনাক্ষিদের কাছে তিনি আজও ‘আইকন’
রাজনৈতিক বিরোধিতা থাকলেও রাজ্যের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী- সকলেই একবাক্যে মেনে নেন সততার প্রসঙ্গে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য প্রশ্নাতীত। পাম অ্যাভিনিউয়ের বাড়িতে দু’কামরার ঘর। তাঁর মুখ্যমন্ত্রীত্বের সময় থেকে জীবনের শেষ দিন অবধি বিলাসিতা তাঁকে ছুঁতে পারেননি এক ছিটেও। যা বর্তমান রাজনীতিতে উদাহরণ।
সাদা ধুতি পাঞ্জাবি, পক্ক কেশ, চোখে চশমা- বামেদের এই লিডারের দৃপ্ত কণ্ঠস্বর, লেখনী, অনুবাদ এসবই বামেদের দলিল হয়ে রয়ে যাবে। দাপিয়ে ছাত্ররাজনীতির পর, ১৯৭৭ সালে সংসদীয় রাজনীতিতে প্রথম পা রাখেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। কাশীপুর কেন্দ্র থেকে। সেবছরই বাংলার শাসন ভার পেল বামেরা। সেই সময় সাংসদ হিসেবে তাঁর ব্রিগেডের মঞ্চে ওঠার সুযোগ হয়নি, কিন্তু পরবর্তীতে বামেদের ‘সেকেন্ড ইন কমান্ড’কে চিনে নিতে দেরি হয়নি জ্যোতি বাবুর। ১৯৯৯ সালে রাজ্যের উপ-মুখ্যমন্ত্রী, পরের বছরেই মুখ্যমন্ত্রীর গুরু দায়িত্ব পান বুদ্ধবাবু। তারপর দীর্ঘ ১১ বছর টানা মুখ্যমন্ত্রীত্ব। ওঠা-পড়া পতন। কেটে গিয়েছে আরও একটা দশক। সকাল থেকেই বুদ্ধবাবুর প্রয়াণের খবর যখন চাউর, বাংলার মানুষ আরও একবার বলতে ভুললেন না ‘বাংলার শেষ শিক্ষিত মুখ্যমন্ত্রী’... আবার কেউ বললেন, ‘শিল্প নিয়ে যে স্বপ্ন তিনি দেখে গিয়েছিলেন, তা স্বপ্নই থেকে যাবে’