বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ লেগেই আছে। দুর্গাপুজো ভাইফোঁটা কালীপুজো সমস্ত কাটিয়ে এবার জগদ্ধাত্রী পুজোর পালা। কারণ দেবী কালীর বিদায়ের পর থেকেই শোনা যায় জগদ্ধাত্রীর পদধ্বনি। আর জগদ্ধাত্রী পুজোর কথা উঠলে প্রথমেই মাথায় আসে চন্দননগরের কথা। এই সময়ে আশপাশের এলাকা তো বটেই, দূরদূরান্ত থেকেও মানুষের ঢল নামে একদা ফরাসি উপনিবেশ চন্দননগরে। আর চন্দননগরের পুজো মানেই চোখধাঁধানো আলোকসজ্জা। কারণ আলোর শহর হিসেবে চন্দননগরের নাম বিশ্বজোড়া।
কিন্তু কীভাবে বিখ্যাত হল চন্দননগরের আলো?
ভাগীরথী নদীর পশ্চিমে গঙ্গার একেবারে ধার ঘেঁষেই রয়েছে হুগলি জেলার চন্দননগর। অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি এখানে জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রচলন হয়। যা নাকি কৃষ্ণনগরের পুজোর অনেক আগে। কথিত রয়েছে চন্দননগরের নদী বন্দর দিয়ে তাঁত বস্ত্র রফতানি করা হত। ব্যাবসায়ীদের উদ্যগেই গঙ্গার তীরে চাউল পট্টিতে প্রথম জগদ্ধাত্রী পুজো শুরু হয়। এরপর ধীরে ধীরে জিটি রোডের পশ্চিমদিকে নিজ নিজ এলাকায় পুজো শুরু করেন বিভিন্ন ব্যবসায়ীরা। এরপর তা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে চন্দননগরের বাইরেও।
যদিও ঠিক কবে চন্দননগরে পুজো শুরু হয় আর চন্দননগর নাকি কৃষ্ণনগর কোথায় আগে জগদ্ধাত্রী পুজো প্রথম শুরু হয় তা নিয়ে বিস্তর মতভেদ রয়েছে। কিন্তু প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, কৃষ্ণনগরের মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রচলন করেছিলেন ১৭৬২ সালে। ওই বছরেই নাকি চন্দননগরেও পুজো শুরু হয়। এরপর এই শহরে বহু বিদেশি শক্তি আধিপত্য বিস্তার করেছে। কিন্তু কখনই জৌলুস হারায়নি চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজো।
এরপর রেলপথ শুরু হয়। আর রেলপথ শুরু হওয়ার পর থেকেই শহরে ভিড় করতে থাকেন দূর-দূরান্তের ভক্তরা। লোকজন আসা শুরু হতেই এই শহরের পুজোর আভিজাত্য ও আয়োজন আরও বেড়ে যায়। পুজোর পাশাপাশি নজর কাড়তে শুরু করে চন্দননগরের শোভাযাত্রা আর চন্দননগরের আলো। শুরু দিকে রাতে শোভাযাত্রা বেরোলে পর্যাপ্ত আলো না থাকায় সমস্যা হত। সেই সময় পিতলের গামলায় ঘুঁটের আগুন জ্বালিয়ে সেগুলি প্রতিমার সামনে রাখা হত।
কিন্তু ঘুঁটের আগুন খুব বেশিদূর পৌঁছত না। বেশিক্ষণ থাকত না। সেই কারণে এরপর ঘুঁটের পরিবর্তে বাঁশের মাথায় কাপড় জ্বালিয়ে কেরোসিন তেল ঢেলে মশাল আকারে ব্যবহার করা হত। ওই মশাল নিয়েই শোভাযাত্রা করা হত। কিন্তু ওই আলো পর্যাপ্ত ছিল না। এরপরেই কালের নিয়মে মশালের জায়গা নেয় অ্যাসিটিলিন গ্যাস এবং ডে লাইট। এরপর ধীরে ধীরে হ্যাজাকের প্রচলন শুরু হয়।
শোভাযাত্রার প্রয়োজনীয় আলোর জোগান দিতে হ্যাজাক বাহক নিয়ে আসা হত পড়শি রাজ্য ওড়িশা থেকে। এরপর ১৯৩৪ সালে চন্দননগরে প্রথম বিদ্যুৎ আসে। এর পাঁচ বছরের মধ্যেই ১৯৩৯ সালে পুজোর মণ্ডপে বৈদ্যুতিক আলো ব্যবহার শুরু হয়। আর ১৯৪৮ সাল থেকে জগদ্ধার্থী পুজোর শোভাযাত্রায় ব্যবহৃত হয় বৈদ্যুতিক টিউবের আলো। এরপর কেটে যায় অয়েক দশক। তারপর ১৯৭৮ থেকে ১৯৮০ সালের মধ্যে শুরু হয় টুনি বাল্বের কাজ।
এই টুনিবাল্বের কারসাজি নজর কাড়তে শুরু করে রাজ্যবাসীর। দূরদূরান্ত থেকে অনেকেই ভিড় করতে থাকেন চন্দননগরে। রাতারাতি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে চন্দননগরের আলো। বরাত পেতে শুরু করেন আলোকশিল্পীরা। বেড়ে ওঠে চন্দননগরের আলোর ব্যবসা। কিন্তু এই টুনিবাল্ব বেশিক্ষণ জ্বললে খুব বেশি উত্তপ্ত হয়ে উঠত। এরপর ২০০৩ সালে আধুনিক প্রযুক্তির এলইডি ল্যাম্প আসে। ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিকতার মেলবন্ধন ঘটান চন্দননগরের আলোকশিল্পীরা।
ধীরে ধীরে একসময়ের ফরাসি উপনিবেশ চন্দননগরের আলোর সুখ্যাতি জগতজোড়া। ষষ্ঠীতে দেবীর বোধন হয়। কিন্তু তার আগে থেকেই আলোয় মুড়ে ফেলা হয়েছে ফরাসডাঙার গলি থেকে রাজপথ। এই আলো শুধু যে চন্দননগরকে আলোকিত করে এমনটা কিন্তু নয়। এই আলো পাড়ি দেয় কয়েক যোজন দূরে কখনও লন্ডন কখন আবার চন্দননগরের আলোয় সেজে ওঠে প্যারিসের আইফেল টাওয়ার।
তখনও চিনা আলোয় বাজার ছেয়ে যায়নি। সেই সময় চন্দননগরে টুনি বাল্ব জ্বালিয়ে আলোর ভেলকি দেখিয়েছিলেন এই আলোকসজ্জার জাদুকর শ্রীধর দাস। চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজোর আলো চন্দননগরের জিনিস দিয়েই তৈরি করে প্রতি বছরই তিনি নিজের জাদু দেখাতেন জেলার অলিগলি, রাজপথে। মস্কো ও লন্ডন কাঁপানো এই আলোকশিল্পী কয়েক বছর আগেই অবসর নিয়েছেন। তবে, এখনও তিনি আলোকশিল্পীদের সাহায্য করেন নতুন নতুন আলোকসজ্জা তৈরি করতে।