কৃষ্ণনগর বাংলার ঐতিহ্যের নগর। নদিয়ার সদর শহরের নাম উচ্চারণ হলেই মনে পড়ে যায় জগদ্বাত্রী পুজো, মাটির পুতুল, সরপুরিয়া ,সরভাজা, গোপাল ভাঁড়, রাজবাড়ির কথা। এই শহরের একটি ঐতিহাসিক ভিত্তিও রয়েছে। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের এই শহর ভোট আবহেও প্রায় প্রতিদিনই শিরোনাম কাড়ছে। এবছর লোকসভা নির্বাচনের প্রার্থী স্বয়ং রাজ বধূ অমৃতা রায়, তাঁর বিপরীতে লড়ছেন হাইভোল্টেজ প্রার্থী মহুয়া মৈত্র।
এবছরই রাজনীতিতে পা রেখেছেন রাণীমা। কৃষ্ণনগরবাসীর কাছে রাজবাড়ি আজও নস্টালজিয়ায় মোড়া এক স্থাপত্য। রাজবাড়ির দরজা জনসাধারণের জন্য খোলা হয় হাতে গোনা মাত্র কয়েকটা দিন। দুর্গা পুজো, জগদ্বাত্রী পুজো আর ১২ দোলের সময়। কী এই ১২ দোল? আজকের প্রতিবেদনে কৃষ্ণনগরের প্রায় দুই শতাব্দী প্রাচীন এই মেলাই ঘুরিয়ে দেখানোর চেষ্টা করছি এডিটরজি বাংলার পর্দায়।
ভোট প্রচারে রাণীমার যখন দম ফেলার জো নেই, তখনই রাজবাড়ির মাঠ জুড়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে শতাব্দী প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী বারো দোলের মেলা। প্রায় ১ মাস যাবৎ এই মেলা চলে রাজবাড়ির মাঠে।
দোল পূর্ণিমার পর শুক্লা একাদশী তিথিতে নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে এই মেলা বসে। এই মেলার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ধর্মীয় এক ইতিহাস, আবার কেউ কেউ বলেন রাজবাড়ির অন্দরের কিছু কাহিনী রয়েছে এই মেলার মূলে।
বারো ঠাকুরের দোল উৎসব বারো দোল:
ঐতিহ্য বজায় রেখে আজও মেলা শুরুর তিন দিন রাজবাড়ির নাটমন্দিরে পূজিত হন ১২ ঠাকুর। শ্রী শ্রী বলরাম, নাড়ুগোপাল, নদের গোপাল, গড়ের গোপাল, গোপীনাথ, বড়ো নারায়ণচন্দ্র- ছোট নারায়ণচন্দ্র, গোষ্ঠবিহারী, গোবিন্দদেব, গোপীমোহন, লক্ষ্মীকান্ত, কৃষ্ণচন্দ্র, ও মদনগোপাল- নদিয়ার বিভিন্ন স্থান থেকে এই ১২ বিগ্রহ এই সময় নিয়ে আসা হয় কৃষ্ণনগর রাজবাড়ীতে। আর এই উৎসবকে কেন্দ্র করেই জমে ওঠে ১২দোলের মেলা। শোনা যায় এই ১২ বিগ্রহ নদিয়ার নানা জায়গায় স্বয়ং কৃষ্ণচন্দ্রই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেই সমস্ত বিগ্রহ জনসাধারণকে দেখার সুযোগ করে দেওয়া হয় মেলার প্রথম তিন দিন। তিন দিন তিন রকম সাজে সাজানো হয় বিগ্রহদের। প্রথম দিন রাজবেশ, দ্বিতীয় দিন ফুলবেশ আর তৃতীয় দিন রাখালবেশ।
রাণীমার আবদারে মেলা:
আবার কেউ কেউ বলেন কৃষ্ণচন্দ্রের ছোটপত্নী অর্থাৎ তাঁর আদরের ছোটন রাজাবাবুর কাছে উলায় মেলায় নিয়ে যাওয়ার আবদার করেছিলেন। কিন্তু বিভিন্ন কাজের চাপে রাজামশাই নাকি একেবারে ভুলে গিয়েছিলেন। এরপরেই তিনি ঠিক করেন রাজপ্রাঙ্গণেই মেলা বসবে। সেসময়ই রাজপণ্ডিতরা বিধান দেন চৈত্রমাসের শুক্লা একাদশী তিথিতে নৃত্য-গীত-সহ দোলায় চড়ালে শুভ হয়। সেই থেকেই এই মেলার শুরু।
তবে কালের নিয়মে এখন কিছু বিগ্রহ আর ১২ দোলে নিয়ে আসা সম্ভব হয় না।
ভক্তদের বিশ্বাস:
এই তিন দিন ভক্তরা বিগ্রহের পায়ে আবির ছুঁইয়ে পুজো দেন। ভিক্ষুকদের চাল অন্ন দিয়েও পুণ্য অর্জনের রীতি রয়েছে। বাড়ির গাছের প্রথম ফল নিবেদন করেন।
মেলবন্ধন:
ধর্ম ভেদাভেদের সময়ে, ১২ দোল যেন মিলনমেলা। কৃষ্ণনগর তথা নদিয়াবাসী সারাবছর এই কটা দিনের জন্য অপেক্ষা করে থাকেন। সমস্ত ধর্ম, বর্ণ, জাত নির্বিশেষে মেলা প্রাঙ্গণে একেক দিন ভিড় জমান প্রায় ৩০ থেকে ৪০ হাজার মানুষ। বাংলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীও এই মেলায় অংশ নেন।
অর্থনৈতিক অবস্থা:
বছরে একবার এই মেলার জন্য দিন গুণতেন জেলার ব্যবসায়ীরা। আজও সেই ধারা অব্যাহত। রাজ্যের বিভিন্ন জেলা থেকে হরেক কিসিমের ব্যবসায়ীরা এক মাসের নামে লক্ষ্মীলাভের আশায় মেলার দোকান দেন।
সার্কাস:
আজকাল সার্কাস উঠেই গেছে, কিন্তু মফঃস্বলের এই মেলায় অন্যতম একটি বড় আকর্ষণ সার্কাস। প্রতিবছর নিয়ম করে মেলায় সার্কাস বসে।
কী কী মিলবে?
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বারোদোল আধুনিক হয়েছে তা বলাই বাহুল্য। বিরাট আয়তনের এই মেলায় বিভিন্ন জেলার হাতের কাজ থেকে শুরু করে বিখ্যাত আইটেম আপনি পাবেন। পাশকুঁড়ার বিখ্যাত চপ থেকে মথুরা কেক, রসমালাই কেক থেকে জিলিপি কী নেই। নিত্যপ্রয়োজনীয় হরেক মাল ১০ টাকা ২০ টাকার জিনিস থেকে। মেলায় মিলবে দামি আসবাবপত্র, ঘূর্ণির বিখ্যাত মাটির পুতুল, কাঁসার বাসন, পিতলের বাসন।
মেলা সাজানো হয়েছে চারটি আলাদা আলাদা বাজারে। চোখ ধাঁধানো এই মেলায় মিলবে শান্তিপুরের তাঁত থেকে বাংলাদেশের মসলিন, মিলবে শান্তিনিকেতনে নানা হাতের কাজও। সব মেলার মতোই এই মেলাতেও অসংখ্য নাগরদোলা আসে। এছাড়া মেয়েদের সাজার জিনিস থেকে, রোদ চশমা ব্যাগের দোকান কী নেই মেলায়? কালবৈশাখী বৃষ্টি মাথায় করেই এই এক মাস বিকেল হলেই কৃষ্ণনগরবাসীর প্রিয় ডেস্টিনেশন বারোদোলের মেলা। এবছর মেলা শেষ ১৯ মে।