দিনটা ছিল বুধবার । লক্ষ্মীপুজোর সকাল । তখনও ঠিকভাবে আলো ফোটেনি । ঘুম ভেঙে কৃষ্ণনগরবাসী সাক্ষ্মী থেকেছিল এক ভয়াবহ নৃশংস ঘটনার । পুজো মণ্ডপের বাইরে অর্ধনগ্ন, অর্ধদগ্ধ অবস্থায় পড়েছিল এক তরুণীর দেহ । সেদিনের ঘটনার পর থেকেই তোলপাড় কৃষ্ণনগর । তরুণীর পরিবারের অভিযোগে পুলিশ তদন্ত শুরু করে । গ্রেফতার হয় তরুণীর প্রেমিক । তদন্তের গতিপ্রকৃতি যত এগিয়েছে, তত উঠে আসছে একের পর এক বিস্ফোরক তথ্য । তরুণীর পরিবারের অভিযোগ, মেয়েকে গণধর্ষণ করে খুন করে তথ্য প্রমাণ লোপাটের জন্য অ্যাসিড দিয়ে পুড়িয়ে মারা হয়েছে । আর তার পিছনে রয়েছে অভিযুক্ত প্রেমিক ও তার গ্যাং । কিন্তু আদৌ খুন নাকি আত্মহত্যা ? সম্প্রতি, পুলিশের হাতে যে বিস্ফোরক তথ্য উঠে এসেছে, তাতেই এমন প্রশ্ন উঠছে ।
কী তথ্য উঠে আসছে, কোন দিকে মোড় নিচ্ছে তরুণীর রহস্যমৃত্যুর ঘটনা...তা জানতে একটু শুরু থেকেই শুরু করা যাক ।
মৃত তরুণীর সঙ্গে তাঁর প্রেমিকের আলাপ সোশ্যাল মিডিয়া সূত্রে । প্রথমে মেসেজে কথা বলা, তারপর নম্বর শেয়ার করা...তারপর বন্ধুত্ব গাঢ় হয় । প্রেমে পড়েন একে অপরের । শুরু হয় রাত জেগে কথা বলা । এমনকী, প্রেমিক কাজ নিয়ে বেঙ্গালুরুতে যখন চলে গিয়েছিল, সেইসময় প্রেমের টানে ওই তরুণীও তাঁর কাছে গিয়ে থাকতে শুরু করেন । বিয়েও করেছিলেন নাকি তারা । ফেসবুক স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন, ম্যারেড । পুলিশ সূত্রে খবর, যুবকটির নম্বর হাজব্যান্ড বলে সেভ করেছিলেন ওই তরুণী । তাহলে হঠাৎ কী হল ?
জানা গিয়েছে, সব ঘটনার নেপথ্যে যুবকের একাধিক সম্পর্ক । পুলিশ সূত্রে দাবি, ওই যুবকের আগে একটি বিয়ে ছিল । তরুণীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়ানোর আগে সোনারপুরের এক তরুণীকে বিয়ে করে । যদিও বছর খানেক আগে তাদের সম্পর্ক ভেঙে যায় । তারপরই ওই যুবকের সঙ্গে আলাপ মৃত তরুণীর ।
কিন্তু, এখানেই শেষ নয় । কৃষ্ণনগরের তরুণীর সঙ্গে সম্পর্কে থাকাকালীনই নাকি একাধিক সম্পর্কে জড়িয়েছিল ওই যুবক । এমনকী তাঁর প্রাক্তন স্ত্রীর সঙ্গে ফের যোগাযোগ তৈরি হয় । সেই বিষয়টা কোনওভাবে জানতে পারে ওই তরুণী । এই নিয়ে প্রায় অশান্তিও হত তাদের মধ্যে ।
এবার আসা যাক,১৬ অক্টোবরের ঠিক আগের দিনের ঘটনায় । পুলিশ সূত্রে খবর, প্রেমিকের সঙ্গে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করছিলেন ওই তরুণী । কিন্তু, ফোন ধরেনি প্রেমিক । পুলিশের হাতে এসেছে মৃত ছাত্রীর ফোনের 'কল রেকর্ড' । সেখান থেকেই নতুন তথ্য হাতে উঠে এসেছে পুলিশের হাতে । পুলিশ সূত্রে খবর, প্রেমিককে না পেয়ে তার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল তরুণী । ওই বন্ধুকে দুপুর ১২টা থেকে রাত ১১টার মধ্যে ২১ বার কল করে ওই তরুণী । তদন্তকারীদের দাবি, প্রেমিক কেন ফোন ধরছে না , কোথায় রয়েছে, এসব প্রশ্নই ওই বন্ধুকে করেন তরুণী । কারণ তিনি কোনওভাবে জানতে পেরেছিলেন ওই যুবক অন্য কোনও মহিলার সঙ্গে ঘুরতে গিয়েছিল সেদিন । শুধু তাই নয়, যুবকের বন্ধুকে আত্মহত্যা করবেন বলেও হুঁশিয়ারি দেন তরুণী । কেরোসিন আনার কথাও বলেন । আর এই সূত্রেই উঠে আসছে কেরোসিন তত্ত্ব ।
প্রশ্ন উঠছে, প্রেমিকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পেরে কেরোসিন নিয়ে গিয়েছিলেন কি ওই তরুণীই ? পুলিশের তদন্ত সূত্রে জানা গিয়েছে, মৃত তরুণী যখন ফোন করে যুবকের বন্ধুকে আত্মহত্যার হুঁশিয়ারি দেন, সেইসময় বিষয়টা তরুণীর প্রেমিককে জানান ওই বন্ধু । তদন্তে পুলিশ জেনেছে, ওই যুবক বিষয়টা পাত্তা দেয়নি। তারপর রাত ১০টা ১২ মিনিট নাগাদ প্রেমিকের সঙ্গে ফোনে কথা হয় ওই তরুণীর । প্রেমিক জানায়, সম্পর্ক শেষ করতে চায় সে । ওই তরুণী তখন কান্নাকাটি শুরু করে । আত্মহত্যার কথাও বলে । এরপরই ১৬ অক্টোবরের ভোরে তরুণীর অর্ধনগ্ন ও অর্ধদগ্ধ দেহ উদ্ধার হয় ।
তবে, সম্প্রতি, একটি সিসিটিভি ফুটেজও প্রকাশ্যে এসেছে । সেখানে দেখা গিয়েছে, রাত দশটা চল্লিশ নাগাদ কৃষ্ণনগরের প্রশাসনিক ভবনের দিক থেকে একাই হেঁটে ঘটনার স্থলের দিকে যাচ্ছে ওই তরুণী । তাঁর পাশ দিয়েই একটি বাইক বেরিয়ে যায় । ওই বাইকে বসেছিল এক যুবক এবং এক তরুণী । মৃত তরুণী যে পথে গিয়েছিল, সেই পথেই যায় বাইকটি । বাইকটি পরে ফিরে আসে, কিন্তু ওই তরুণী আর ফিরে আসেননি ।