‘ধর্ম যার যার, বড়মা সবার’
নৈহাটির বড়মা- বিশ্বাস, ভক্তি, মিথ, লৌকিক অলৌকিকতার এক মিশেল। বাড়ির রক্ষাকালী থেকে জনসাধারণের বড়মা হয়ে ওঠেন এই দেবী। তাঁর মাহাত্ম্যে বিশ্বাস রেখে প্রতিবছর দ্বিপান্বিতা অমাবস্যায় লাখো ভক্তের সমাগম হয় নৈহাটির ধর্মশালায়। প্রথমে ভবেশ চক্রবর্তীর বাড়ির ছিল এই পুজো। ছোট করেই এই পুজো করতেন কালী সাধক ভবেশ। ২১ বছর বয়স থেকেই তিনি রক্ষাকালীর পুজো করতেন। প্রথমে তাই এই দেবীর নাম ছিল ভবেশ কালী। পরে এই পুজো হয়ে ওঠে সর্বসাধারণের।
‘ভবেশ কালী’ থেকে ‘বড়মা’ হওয়ার যাত্রা:
আজ থেকে ১০১ বছর আগে এই পুজো শুরু করেছিলেন ভবেশ। তবে তিনি অবস্থাপন্ন ছিলেন না। এমতাবস্থায়, তৎকালে একবার ভবেশ তাঁর চার বন্ধুর সঙ্গে শান্তিপুরে রাসের মেলা দেখতে গিয়েছিলেন। সেখানে বিশালাকৃতি রাধা-কৃষ্ণের মূর্তি দেখে চমক লেগে যায় ভবেশ চক্রবর্তীর। কিন্তু তিনি অবস্থাপন্ন ছিলেন না, অথচ বড় কালী পুজোর কথা মনে মনে ভেবেও ফেলেছিলেন তিনি। সেই সময় তাঁর কিছু বন্ধু এগিয়ে আসেন। তাঁরা যথাসাধ্য সাহায্য করেন, এরপরেই পুজো শুরু হয় । তখন থেকেই বিশাল উচ্চতার এই কালী ভবেশ কালী থেকে বড়মা নামে প্রতিষ্ঠিত হন।
নেওয়া হয় না চাঁদা:
বড় মায়ের এই পুজো সর্বজনীন হলেও পুজোর জন্য এক পয়সাও চাঁদা নেন না উদ্যোক্তারা। বরং না চাইতেই, ভক্তরা উজাড় করে দেন বড় মাকে। এই মুহূর্তে বড়মা-এর লকারে গচ্ছিত রয়েছে প্রায় ১০০ ভরি সোনা এবং ২০০ ভরি রুপোর গয়না। এছাড়াও মানত অনুযায়ী, শাড়ি ভোগের সামগ্রী, আলতা সিঁদুরে ভরে যায় বড়মা-এর ভাণ্ডার। এবং প্রতিবছর এই ভাণ্ডার ক্রমেই বাড়ছে।
বৈষ্ণব মতে পুজো:
স্বর্গীয় ভবেশ চক্রবর্তী ছিলেন বৈষ্ণব। গলায় কণ্ঠী ধারণ করতেন তিনি। তাই শাক্ত মতে নয় বড় মায়ের পুজো হয় বৈষ্ণব মতে। বলির প্রথা চালু নেই, দেবীকে দেওয়া হয় না কারণও। কোজাগরী পূর্ণিমার দিন কাঠামো পুজোর মাধ্যমে শুরু হয় বড়মা-এর পুজো।
বড়মা এবং মাহাত্ম্য:
নৈহাটির বড়মা’এর রূপ নয়নাভিরাম। মূর্তির উচ্চতা ২১ ফুট বা প্রায় ১৪ হাতের। চার হাত মায়ের। কথিত আছে দেবী তাঁর সন্তানদের কষ্ট দেখতে পারেন না। তাই ভক্তরা কিছু চাইলে, সেই আন্তরিক প্রার্থনা বিফলে যায় না। মনোবাসনা পুরো হলে ফের ভক্তরা ফিরে আসেন। গতবছর ১০০ বছরে পা রেখেছে বড়মায়ের পুজো। এ বছর মাকে নিবেদন করা হয়েছে রুপোর ঘট ও চাবি।
কড়া নিরাপত্তা বড়মা-এর পুজোতে:
কড়া নিরাপত্তায় মুড়ে পুজো চলে বড়মায়ের। কারণ প্রতিবছর কালী পুজোর দিন কয়েক লক্ষ ভক্তের ঢল নামে বড়মা-র উঠোনে। প্রায় কয়েকশো পুলিশ মোতায়েন করা হয় গোটা এলাকায়। সঙ্গে, থাকে শয়ে শয়ে স্বেচ্ছাসেবক।
বড়মা দর্শনের সময়:
৩১ অক্টোবর, বৃহস্পতিবার পুজো হবে বড়মা-এর। অমাবস্যা তিথি শুরু দুপুর ৩টে ৯মিনিটে। পুজো শেষ হবে শুক্রবার সন্ধ্যা ৫টা ৯মিনিটে। বুধবার থেকে সোমবার পর্যন্ত প্রতিমা দর্শনের সুযোগ পাওয়া যাবে।
এর আগে বড়মা দর্শনের জন্য অপেক্ষা করে থাকতে হত কালীপুজোর উপরেই। কিন্তু গতবছর থেকে শুরু হয়েছে বড় মায়ের নিত্য পুজো। কষ্টিপাথরের মূর্তি হয়। দেবীর মন্দিরে ওই মূর্তিতেই নিত্য পুজো হয়।
বিসর্জনের নিয়ম:
গা ভরা সোনা রুপো খুলে রেখে, বিসর্জনের আগে ফুলের গয়নায় সাজানো হয় বড়মাকে। তারপর চাকা লাগানো গাড়িতে চড়ে নিরঞ্জনের উদ্দেশে রওনা হন বড়মা। ভক্তদের ঢল নামে সেখানেও। বড়মায়ের বিসর্জনের পর , শুরু হয় অন্যান্য প্রতিমার নিরঞ্জন। আবার একবছরের অপেক্ষা নিয়ে বিদায় নেন ভক্তরা।