সোমবার ছিল তৃণমূলের কর্মসমিতির বৈঠক। ডাক পেয়েছিলেন অনুব্রত মণ্ডল। নীচুপট্টির বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি জানিয়েছিলেন দিদির কাছে ভাই যাচ্ছে। তখন থেকেই জল্পনা উঠতে শুরু করেছিল তাহলে কি ফের স্বমহিমায় দেখা যাবে অনুব্রতকে? ক্ষমতা খর্ব করা হতে বীরভূমের তৃণমূল নেতা কাজল শেখের?
অনুব্রত মণ্ডল। বীরভূমে একটা সময় ছিল যখন এই নামটাই যথেষ্ট! দোর্দন্ডপ্রতাপ এই নেতার উপরেই জেলার দায়িত্ব দিয়ে একপ্রকার নিশ্চিন্তে ছিলেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তারপর গরু পাচার মামলায় অনুব্রতকে গ্রেফতার করে CBI এবং ED। প্রায় দেড় বছর তিহার জেলে থাকার পর চলতি বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর ফের নিজ গড়ে ফিরে আসেন অনুব্রত।
বীরভূমে ফিরে এসে কি আগেই অবস্থাতেই দেখা যাবে অনুব্রত মণ্ডলকে? ফের কি রাজনৈতিক কর্মসূচিতে সক্রিয় হবেন তিনি? এনিয়ে একাধিক প্রশ্ন উঠলে নীরব-ই থেকে গিয়েছেন অনুব্রত মণ্ডল।
অনুব্রতকে গ্রেফতারির পর ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে নিজে বীরভূম জেলায় গিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দলের কাজ সামলানোর জন্য কার্যকারী কমিটি গঠন করে দিয়েছিলেন তিনি। সেই কমিটিই পঞ্চায়েত নির্বাচন এবং লোকসভা নির্বাচনের দায়িত্ব সামলেছিল। যার মাথায় ছিলেন কাজল শেখ।
রাজনৈতিক মহলের বক্তব্য, বীরভূমের কাজল শেখ যে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্নেহভাজন তা বারেবারে প্রকাশ পেয়েছে। পাপুড়িয়ে বিশাল জনসভায় সর্বভারতীয় সম্পাদককে হাজির করে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন কাজল। অন্যদিকে দীর্ঘদিন ধরেই বীরভূমকে অনুব্রতর চোখ দিয়েই দেখে আসছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ফলে কার কাঁধে ভার দিয়ে ২০২৬-এর ভোট বৈতরণী পার হতে চায় তৃণমূলের দুই কাণ্ডারী সেই নিয়ে কিন্তু প্রশ্ন রয়েই গিয়েছে।
শুধু তাই নয়, গত ৭ নভেম্বর নিজের জন্মদিনে সাংবাদিকদের একটি প্রশ্নের জবাবে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, বীরভূমের কোর কমিটির নেতৃত্বে যেহেতু নির্বাচনে ভালো ফল করেছে তৃণমূল সেই কারণে ওই কমিটি রেখে দেওয়ার পক্ষে তিনি। অভিষেকের ওই মন্তব্যের পর কোর কমিটির বৈঠক ডাকা হয়। ওই বৈঠক শেষে তৃণমূলের একটি নেতৃত্ব জানান, যে সব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে তাতে দলের রাশ কোনও একপক্ষের হাতে আর রইল না।
যদিও বোলপুরে ফিরলেও দলের কাজকর্মে যে অনুব্রত মণ্ডল অতি সক্রিয় এমনটা কিন্তু দেখা যায়নি। দেখা হয়নি তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেও। অবশেষে সোমবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কালীঘাটের বাড়িতে তৃণমূলের কর্মসমিতির বৈঠক হয়। জেল থেকে ফিরে আসার পর সেটাই তৃণমূল সুপ্রিমোর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাত অনুব্রতর।
রাজনৈতিক মহলের বক্তব্য, তৃণমূলে এখন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্য়ায় প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছেন। তাঁর নেতৃত্বেই একাধিক বড় বড় সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে বলে অনেকের ধারণা। এমনকি, অভিষেককে একাধিক দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়েও সুর চড়া করেছেন অনেক শীর্ষ নেতা। সূত্রের খবর, বীরভূম নিয়ে একাধিক আলোচনা হলেও ওই জেলাকে নিজের মতো করে চালাতে চাইছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায়। আর সেই কারণে অনুব্রত মণ্ডলের উপরেই ধীরে ধীরে দায়িত্ব বাড়ানোর দিকে হাঁটতে পারেন তৃণমূল নেত্রী।
অনুব্রত মণ্ডলের গ্রেফতারির পর একপ্রকার আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে। এমনটাই মনে করেছিলেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাঁদের মধ্যে অনেকের ধারণা ছিল, দল পরিচালনা এবং নির্বাচনের ক্ষেত্রে বীরভূম জেলার ক্ষেত্রে অনুব্রত মণ্ডলই ছিল শেষ কথা। তাঁকে গ্রেফতারির পর সেই জায়গায় ধাক্কা লাগতে পারে।
তৃণমূল সূত্রে খবর, অনুব্রতহীন বীরভূমে কতটা ছাপ ফেলতে পারবেন কাজল শেখ সেই নিয়ে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু ২০২৩ সালের ১৩ জুলাই পঞ্চায়েত নির্বাচনের ফল প্রকাশ হতেই সেই সন্দেহ কিছুটা দূর হয়। বীরভূম জেলার ১৬৭টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে ১৪০টি দখল করে তৃণমূল কংগ্রেস। BJP পেয়েছে ৭টি, জোট পেয়েছে ৪টি এবং ত্রিশঙ্কু হয়েছিল ১৬টি। পঞ্চায়েত সমিতির ক্ষেত্রে ১৯টি আসনের ১৯টিই তৃণমূল দখল করে। এছাড়াও জেলা পরিষদের ৫২টি আসনের মধ্যে ৫১টি দখল করে TMC। আস্থা আরও বাড়ে লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলে।
অনুব্রত মণ্ডল না থাকা অবস্থাতেও বীরভূমে বিপুল আসনে জেতায় কাজল শেখের উপরেই আস্থা দেখাতে শুরু করে তৃণমূল কংগ্রেস। তবে জেলার অনেক নেতার সঙ্গে যে কাজলের সখ্যতা নেই তা অনেকেই জানিয়েছিলেন।
জেলা নেতাদের অনেকেই আড়ালে কার্যত স্বীকার করে নিয়েছিলেন, কোর কমিটিতে জায়গা পাওয়ার পর ক্ষমতা জাহির করতে শুরু করেন কাজল শেখ। কলকাতায় এসে পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের সঙ্গে দেখা করে জেলার রিপোর্টও জমা করেছিলেন বলে সূত্রের খবর।
এই পরিস্থিতিতে অনুব্রত মণ্ডলের ফের বীরভূম ফিরে আসা এবং তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বৈঠকের পর প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে তাহলে কি ফের পুরনো অবস্থায় দেখা যাবে অনুব্রত মণ্ডলকে?
কালীঘাটে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে কর্মসমিতির বৈঠক হয়। সেখানে একাধিক কমিটি গঠন করে দেন স্বয়ং তৃণমূল নেত্রী। সূত্রের খবর, সব ক্ষমতার রাশ নিজের হাতেই রেখেছেন মমতা। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মত সেই হিসেবে, অনুব্রত মণ্ডল তৃণমূল নেত্রীর ঘনিষ্ঠ বৃত্তের মধ্যেই রয়েছেন। ফলে এখনই যে অনুব্রত মণ্ডলের হাত থেকে জেলার ক্ষমতা খর্ব কমিয়ে নেওয়া হবে এমনটাও মনে করছেন না রাজনৈতিক মহল।