২০ নভেম্বর কাতার। হাতের সামনে পড়ে থাকা একটা কাগজের টুকরো তুলে নিয়েছিলেন তিনি। তাতে লিখেছিলেন, কথা দিচ্ছেন, মেসির জন্যই তাঁরা বিশ্বকাপ জিতবেন। ১৮ ডিসেম্বর কাতার। বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা। কাপ জয়ের পরেও যেন সেই দিনের কথা বিভোর ২৮ বছরের আর্জেন্টিনার মিডফিল্ডের অন্যতম স্তম্ভ রগরিডো ডিপল। ডিপল জানিয়েছেন, ওই দিন একঘরে মেসির সঙ্গে কথা বলে তিনি লিওর মনের কথা বুঝতে পেরেছিলেন। বুঝতে পেরেছিলেন এবার বিশ্বকাপ জয় কতটা জরুরি। একথা-সেকথার মধ্যে হঠাৎ দেখলেন তাঁর পাশে মেসি নেই। নিজের মনের কথা আর বেশিক্ষণ মনের মধ্যে জমিয়ে রাখতে পারেননি। শপথ বাক্যের মতোই লিখে ফেলেছিলেন ওই কাগজের টুকরোর উপরে।
আটচল্লিশ ঘণ্টা পর। দোহার লুসাইল স্টেডিয়াম। মেসি, আর্জেন্টিনা ও বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্নে বাস্তব সৌদি আরব। বিশ্বকাপের মঞ্চে সবচেয়ে বড় অঘটনের দিনেই বিপদ ঘণ্টা বাজিয়ে ছিলেন আর্জেন্টাইন কোচ লিওনেল স্কালোনি। ম্যাচ জয়ের পর সৌদি কোচ রেনার্ড হার্ভে যখন দাবি করেছিলেন, মিলিয়ে নেবেন এই আর্জেন্টিনাই বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হবে, তখন রুক্ষ বাস্তবের মধ্যে দাঁড়িয়ে লিও মেসি বলেছিলেন, আস্থা রাখুন দল ঘুরে দাঁড়াবে।
আসলে কোপা আমেরিকা জয়ের আগে থেকেই এই আর্জেন্টিনা দলের মাঝমাঠ নিয়ে আদা-জল খেয়ে পড়েছিলেন স্কালোনি। দায়িত্ব নিয়ে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন এই দলে সব ঠিক আছে। নেই শুধু মাঝমাঠ। তাই গত কয়েকদিন ধরে নাগাড়ে দলের মিডফিল্ড নিয়ে নানা অঙ্ক কষেছেন। ব্রাজিল যেখানে ৯ জন গোল মেশিন নিয়ে বিশ্বকাপে এসেছিল। আর্জেন্টিনার রসদ ছিল মাঝমাঠ। ডিপল-প্যারাডেজ-সেলসো। এই ত্রিভূজে আস্থা রেখেই কাতারে এসেছিলেন স্কালোনি। কিন্তু তিনি ধাক্কা খান সেলসোর চোট।
আর বিলম্ব নয়। সৌদি ম্যাচ থেকে শুরু হয়েছিল মাঝ মাঠ নিয়ে তাঁর পরীক্ষা। প্রথম ম্যাচেই মাঠে নামিয়েছিল নতুন পাঁচ জনকে। এরমধ্যে মাঝমাঠে ডি মারিয়ার সঙ্গে ডিপল, প্যারাডেজ এবং পাপু গোমেজ। মেক্সিকো ম্যাচে আবার দুই নতুন মুখ। এবার মাঝমাঠে গুডিও রডিগেজের সঙ্গে অ্যালেক্স ম্যাক-অ্যালেস্টার। এই বিশ্বকাপে যিনি সবচেয়ে বেশি দল নিয়ে পরীক্ষার পথে হেঁটেছেন, তিনি হলে আর্জেন্টাইন কোচ লিওনেল স্কালোনি। গোলে মার্টিনেজ, সাইড ব্যাকে মলিনা, দুই ডিফেন্ডার রোমেরো এবং ওটামেন্ডি, মাঝমাঠে ডিপল, আর সামনে মেসি। সৌদি আরব থেকে ফ্রান্স প্রথম এগারোয় এই নামগুলি স্থির। কখনও অ্যাকুনা, কখনও এনজো ফার্নান্ডেজ, কখন হুলিয়ান আলভারেজ, বদলে বদলে গিয়েছে এই নামগুলি।
২১ বছরের এনজো, ২৩ বছরের ম্যাক-আলেস্টার, ২২ বছরের আলভারেজ। বিশ্বকাপের আগে পর্যন্ত যাঁদের আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতা হাতে গোনা। বিশ্বকাপ এগিয়েছে স্কালোনিকে ভরসা যুগিয়েছে। তাই সাহস দেখিয়েছেন আর্জেন্টাইন কোচ। ম্যাচ প্রতি বদলেছেন কৌশল। কখন চার-তিন-তিন। আবার কখনও পাঁচ ব্যাকে দল সাজিয়েছেন। মিডফিল্ডে ওয়ার্ক লোড নিয়েছেন ডিপল অ্যান্ড কোম্পানি।
বিশ্বকাপ ফাইনালে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে মেসি গোল করতেই একটা নতুন ছকে আর্জেন্টিনা। ৩৮ মিনিটে ডি মারিয়ার গোল চার-দুই-দুই-দুই ছকের ফসল। আসছে চার বছর নিঃসন্দেহে চর্চায় থাকবে লিওনেল স্কালোনির এই কৌশল। চর্চায় থাকবে আর্জেন্টিনার সর্বকালের সেরা মিডফিল্ড তৈরির পিছনে যাবতীয় কসরত। আর থাকবে মাঠে দাঁড়িয়ে খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার বুদ্ধিদীপ্ততা।
১৮ ডিসেম্বর, কাতার। লুসাইল স্টেডিয়ামে আর্জেন্টিনার বারপোস্ট সেলিব্রশনে সবাই অবাক। কারণ, বিশ্বজয়ী এই দল মনে করে এই তে-কাঠিই আসল। দল যখন বারপোস্টের মাথায়। তখন এক কোণে দাঁড়িয়ে এই আর্জেন্টিনার আসল বিশ্বকর্মা লিওনেল স্কালোনি। মাথায় তখন আবার মিডফিল্ড ঘিরেই চিন্তা।