'এত ভঙ্গ বঙ্গদেশ, তবু রঙ্গে ভরা..'। সত্যিই তো! ফুটবল থেকে ফ্যাশন, কৃষ্টি থেকে ক্রিকেট, সবেতেই বাঙালির দলাদলি যেমন আছে, তেমনই আছে উথলে ওঠা আবেগ। গত দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে যে আবেগ আচ্ছন্ন করেছে আপামর পশ্চিমবঙ্গবাসীকে, তার নাম কলকাতা নাইট রাইডার্স৷ সেই আবেগের উচ্চারণ, 'করব লড়ব রে, জিতব রে..'। কলকাতা নাইট রাইডার্স বাঙালি ক্রিকেমপ্রেমীর কাছে সেই আশ্চর্য 'বাজিগর', যে শেখায়, 'কভি কভি জিতনে কে লিয়ে কুছ হারনা ভি পরতা হ্যায়..', তাই IPL-এর ইতিহাসে মাত্র দুবার চ্যাম্পিয়ন হওয়া এই টিমের ম্যাচ দেখতে উপচে পড়ে গ্যালারি।
আসলে KKR মানেই বিশুদ্ধ আবেগ। নিখাদ ভালোবাসা, কখনও আবার নিখাদ অভিমানও। ২০০৮ সালে যখন IPL যাত্রা শুরু, জুহি চাওলাকে সঙ্গে নিয়ে বলিউডের বাদশা শাহরুখ খান তৈরি করে ফেললেন নাইট বাহিনী।
কলকাতার দল। তাই নাইটদের নেতৃত্ব কে দেবেন, তা নিয়ে সংশয়ের কোনও অবকাশই ছিল না। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। বাংলার চিরকালীন ক্রিকেট আইকন৷ কিন্তু মহারাজা আর বাদশার যুগলবন্দি মাঠের বাইরে যতখানি সফল হল, মাঠের ভিতরে ততোখানি নয়। সৌরভ ২৭ ম্যাচে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন নাইটদের। ১৩টি জয়, ১৪টি হার। গ্যালারিতে আবেগের বিস্ফোরণ ঘটেছে, দাদা আর কিং খানের জুটিকে নিয়ে বাঁধভাঙা উন্মাদনায় মেতেছে শহর, কিন্তু অধরা থেকেছে সাফল্য। রেকর্ড বই বলছে, প্রথম তিনটি মরশুমে প্লে অফে যেতেই পারেনি কেকেআর। প্রথমবার ৮ দলের মধ্যে ষষ্ঠ হয় নাইটরা। দ্বিতীয়বার সর্বশেষ স্থানে, অর্থাৎ ৮ নম্বরে শেষ করে। তৃতীয়বারও ষষ্ঠস্থান জোটে।
পরের মরশুমে কলকাতার সিংহাসন ছাড়তে হল মহারাজকে। 'দাদা'কে ছাড়া কলকাতার দল? কিং খানের নাইট বাহিনী থেকে একরাশ অভিমানে প্রথম প্রথম মুখ ফিরিয়েছিল বাংলার ক্রিকেটপ্রেমীদের একটা বড় অংশ। অথচ, ২০১১ থেকেই সাফল্যের সড়কে উঠে এল KKR। দলের অধিনায়ক গৌতম গম্ভীর। সেই প্রথম চতুর্থ হয়ে প্লে অফে জায়গা করে নেন নাইটরা। এলিমিনেটরে মুম্বই-এর কাছে হেরে গেলেও এটি প্রকৃত অর্থেই নাইট রাইডার্সের-এর 'রেনেঁশা বর্ষ'। এক পাল্টে যাওয়া কলকাতা নাইট রাইডার্স পরের বছর, ২০১২ সালে চ্যাম্পিয়ন হল IPL-এ! কোচ ট্রেভর বেলিস। অধিনায়ক গৌতম গম্ভীর। পাগলপারা আনন্দে মেতে উঠল গোটা রাজ্য। ক্রিকেটের নন্দনকাননে সরকারি সংবর্ধনা দেওয়া হয় বিজয়ী নাইটদের। সেই উদযাপনের একটি আশ্চর্য দৃশ্য ঢুকে পড়ল আধুনিক বাংলার রূপকথায়। 'দিদি' মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কপালে চুমু এঁকে দিচ্ছেন ভাই শাহরুখ। ততদিনে গম্ভীরও হয়ে উঠেছেন 'কলকাতার ঘরের ছেলে'। কেকেআর গম্ভীরের কাছে আর শুধুমাত্র একটা ফ্র্যাঞ্চাইজি নয়, দিল্লির ছেলের হৃদয়জুড়ে তখন এই শহর। তিলোত্তমাও গম্ভীরকে ভরিয়ে দিচ্ছে ভালোবাসায়।
টানা তিন বছরের লজ্জাজনক হারের পর ২০১১-র আইপিএল জয় চাঙ্গা করে দিল গোটা স্কোয়াডকে। পরের বছর ফের ব্যর্থতা। ৯ দলের মধ্যে সপ্তম স্থান কলকাতার। দুর্দান্ত কামব্যাক করে ২০১৪ সালে দ্বিতীয়বার IPL চ্যাম্পিয়ন হল নাইট রাইডার্স। কেকেআরের 'হল অফ ফেমে' জায়গা করে নেয় কোচ বেলিস এবং ক্যাপটেন গম্ভীরের জুটি! চিন্নাস্বামীর ফাইনালে পঞ্জাব কিংসকে ৩ উইকেটে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় কলকাতা। গম্ভীর জমানায় ৪ বছরে দুবার IPL জিতে KKR প্রমাণ করেছিল, ধৈর্য ধরলে সাফল্য আসবেই৷
তারপর থেকে অবশ্য সুদীর্ঘ খরা চলছে। গত ৯ মরশুমে একটিবারও আইপিএল জিততে পারেনি দল৷ ২০১৫ সালে প্লে অফ মিস, ২০১৬-২০১৭,২০১৮ সালে পর পর তিন বছর প্লে অফ খেললেও নাইটদের ঘরে ট্রফি আসেনি। ২০১৯-২০২০তে ফের গ্রুপ স্টেজ থেকেই বিদায়। ২০২১ সালে, করোনা আবহে আবার জ্বলে উঠল কলকাতা। নাইটদের খেলা দেখে ঘরবন্দি বাঙালি একটু একটু করে স্বপ্ন বুনল আবার। কিন্তু কাপ আর ঠোঁটের ফারাক তো কখনও কখনও অনন্ত হয়ে যায়। দুবাইয়ের ফাইনালে CSK-এর কাছে ২৭ রানে হেরে রানার্স হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় কলকাতাকে।
KKR-এর যাত্রা যখন শুরু হয়, তখন বেশ কিছু বাংলার ক্রিকেটার ছিলেন টিমে। ঋদ্ধিমান সাহা, লক্ষ্মীরতন শুক্লা, দেবব্রত দাস, অশোক দিন্দা, মনোজ তিওয়ারিরা ছিলেন নাইট শিবিরের বিশ্বস্ত যোদ্ধা। সৌরভ তো ছিলেনই৷ বিগত কয়েক মরশুমে টিমে বাংলার ক্রিকেটার তেমন কেউ নেই৷ কিন্তু দলের নামে তো আছে 'কলকাতা', তার আশ্চর্য সম্মোহনই আবেগে ভাসিয়ে দেয় কুচবিহার থেকে কাকদ্বীপ, কাঁথি থেকে কৃষ্ণনগর। রাসেল, নারিন, শ্রেয়সদের জন্য গর্জন করে ওঠে ক্রিকেটের নন্দনকানন।
গত দুবছরে দলের সার্বিক পারফরম্যান্স তেমন ভালো না হলেও তরুণ নক্ষত্রের মতো জ্বলে উঠেছেন রিঙ্কু সিংয়ের মতো প্রতিভারা। এবছর কি অন্য কিছু হবে? গ্রুপ স্টেজে সবার আগে ছিল শ্রেয়স আইয়ারের দল। প্রথম দল হিসাবে পৌঁছে গিয়েছে ফাইনালে। দলের মেন্টর হয়ে ফিরে এসেছেন গম্ভীর, যার বুকের বাঁ দিকের অনেকটা জমি দখল করে রেখেছে 'সিটি অফ জয়'।
আর তো মাত্র একটা ধাপ। পারবেন না নাইটরা কোটি কোটি অনুরাগীর মুখে হাসি ফেটাতে? এই IPL-এ '.. ওয়ান লাস্ট ড্যান্স'-এর অপেক্ষায় দার্জিলিং থেকে দীঘা, শিলিগুড়ি থেকে সুন্দরবন....