ঘটনা ১- ধরে নিন আপনি বাড়িতে বা অফিসে রয়েছেন। হঠাৎ আপনার হোয়াসটঅ্যাপে একটি ভিডিয়ো কল এল। আপনি ফোনটি ধরলেন এবং দেখলেন অপর প্রান্তে একজন পুলিশের পোশাক পরে বসে রয়েছেন। ফোনটি রিসিভ করার সঙ্গে সঙ্গে জাননো হল 'ডিজিট্যাল অ্যারেস্ট' করা হয়েছে আপনাকে।
ঘটনা ২- প্রথমে ফোন নয়। আপনার Whatsapp-এ আগে থেকে একটি মেসেজ আসবে। সরাসরি অভিযোগ করা হয়, আপনি অবৈধ কারবারে যুক্ত। ড্রাগ সহ নিষিদ্ধ মাদক দ্রব্য বিদেশে পাচার করেন। এবং বিষয়টি নিয়ে কথা বলার জন্য আপনাকে ভিডিয়ো কলে যুক্ত হতে হবে। তারপরই শুরু হবে ভিডিয়ো কল। আপনাকে ফাঁদে ফেলার প্রক্রিয়া শুরু করবে প্রতারকরা।
আসা যাক মূল বিষয়ে-
দুটি বিষয় আদতে একই। সাধারণ মানুষকে ফাঁদে ফেলে টাকা হাতিয়ে নেবে প্রতারকরা। কয়েক হাজার টাকা নয়, আপনি বুঝে ওঠার আগেই লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিতে পারে প্রতারকরা। বিষয়টি এমন পর্যায়ে গিয়েছে যে উদ্বিগ্ন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
ডিজিট্যাল অ্যারেস্ট কী?
এক কথায় বলতে হলে বলা যেতে পারে এটা সম্পূর্ণ ভুয়ো। আইনি পরিভাষায় 'ডিজিট্যাল অ্যারেস্টের' কোনও ভিত্তি নেই। অনলাইন প্রতারকদের তৈরি করা একটি শব্দ। ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করতেই এই পথ অবলম্বন করে অপরাধীরা।
কীভাবে পুরো বিষয়টি কন্ট্রোল করে প্রতারকরা?
অতীতে যে অনলাইন স্ক্যাম বা প্রতারণা করা হত তা ফোন কলের মাধ্যমে। OTP বা কার্ড নম্বর হাতিয়ে অপরাধীরা টাকা হাতিয়ে নিত অপরাধীরা। আর এতে ব্যাঙ্কেরও সেভাবে কোনও ভূমিকা থাকে না। ফলে টাকা ফেরতেরও খুব একটা সম্ভাবনা থাকে না।
কিন্তু নতুন উপায়ে ভিডিয়ো কলের পথ বেছে নিয়েছে প্রতারকরা। থানার আদলে তৈরি করা হয় একটি স্টুডিয়ো অথবা ব্যাকড্রপ। আর যে ভিডিয়ো কল করে সেও পুলিশের পোশাক পরে থাকে। ফলে ভিডিয়ো কল করার সঙ্গে সঙ্গে দেখে মনে হয় কোনও থানা থেকে ভিডিয়ো করা হয়েছে।
প্রথমে পুলিশের পোশাক পরা সেই প্রতারক নিজেকে CBI, ED, নারকোটিক্স বা কেন্দ্রীয় তদন্তকারী কোনও সংস্থার আধিকারিক হিসেবে পরিচয় দেয়। এরপর, যাঁকে ফোন করা হয়েছে তাঁর বিষয়ে বেশ কিছু তথ্য প্রকাশ করতে থাকে ওই প্রতারক। যাতে করে ওই ব্যক্তির কাছে প্রতারকের বিশ্বাসযোগ্য়তা জন্মায়। অবশেষে প্রতারক জানায়, ওই ব্যক্তির নামে ড্রাগ বা অন্য কোনও নেশা দ্রব্য অন্য কোনও দেশে পাচার করা হচ্ছিল। এবং পাচারের সময় ওই দ্রব্য বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে।
এরপরই শুরু হয় আসল খেলা। প্রতারকের তরফে কয়েক লাখ টাকা দিয়ে অভিযোগ মিটিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়। ভয় পেয়ে সেই টাকা দিতে রাজি হয়ে যান অনেকেই। আর যাঁরা টাকা দিতে রাজি হন না, তাঁদের গ্রেফতার করার হুঁশিয়ারি দেয় প্রতারকরা।
কী কী হাতিয়ে নেয় প্রতারকরা?
ভয় দেখিয়ে প্রতারকরা শুধু যে টাকা হাতিয়ে নেয় এমনটা নয়। পাসপোর্টের ডেটা, ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্ট নম্বর, ডেবিট এবং ক্রেডিট কার্ডের নম্বর জেনে নেয় প্রতারকরা। ফলে ওই তথ্যগুলি দিয়ে ভবিষ্যতেও প্রতারণা করতে পারে অপরাধীরা।
কীভাবে সুরক্ষিত থাকবেন সাধারণ মানুষ?
অচেনা নম্বর থেকে হোয়াটসঅ্য়াপ বা অন্য কোনও অ্যাপে ভিডিয়ো কল এলে সেগুলি অ্যাকসেপ্ট করবেন না। এমনকি অডিয়ো কল এলেও তা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করুন। প্রয়োজনে সেই নম্বর পুরোপুরি ব্লক করুন। নম্বর ব্লক করতে সমস্যা হলে ফোন বা ল্যাপটপ থেকে ইন্টারনেট সংযোগ পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করুন।
যদি ভুল করে ফোন ধরে নেন তাহলে কয়েকটি কাজ অবশ্যই করা জরুরি। প্রথমত কোনও গোপন নম্বর বা পিন অথবা কোনও সরকারি নথির তথ্য শেয়ার করবেন না। দ্বিতীয়ত ভিডিয়ো কলের একটি স্ক্রিনশট নিয়ে রাখুন। অপরপ্রান্ত থেকে ভিডিয়ো কলের মাধ্যমে কিছু দেখানো হলে তারও স্ক্রিনশট সংগ্রহ করুন।
প্রতারণার শিকার হলে কী করবেন?
অনেকে না জেনেই এই প্রতারণার শিকার হন। ফলে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় প্রতারকরা। সেক্ষেত্রে অবশ্যই ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টগুলি দ্রুত ফ্রিজ করুন। প্রয়োজনে ইন্টারনেট ব্যাঙ্কিংয়ের পাসওয়ার্ডগুলি যত দ্রুত সম্ভব পরিবর্তন করা জরুরি।
অভিযোগ জানাবেন কোথায়?
কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে ডিজিট্যাল অ্য়ারেস্ট বা এই ধরনের কোনও প্রতারণার শিকার হলে অভিযোগ জানানোর জন্য একটি বিশেষ পোর্টাল ও নম্বর চালু করা হয়েছে। ১৯৩০ নম্বরে ফোন করে অভিযোগ জানাতে পারেন যে কেউ।
উদ্বেগ প্রধানমন্ত্রীর
রবিবার ছিল মন কি বাত অনুষ্ঠান। ওই অনুষ্ঠানে বক্তব্যের বেশ কিছুটা অংশজুড়ে ডিজিট্যাল অ্য়ারেস্ট নামে প্রতারণা নিয়ে বক্তব্য রাখেন প্রধানমন্ত্রী। পুরো বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট উদ্বেগ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
সচেতনতা বৃদ্ধি
শুধু নম্বর ব্লক বা অভিযোগ জানিয়ে এই সমস্যার সমাধান পাওয়া যাবে না। সেক্ষেত্রে সাধারণ মানুষকে সচেতন হতে হবে। অচেনা নম্বর থেকে ভিডিয়ো কল রিসিভ সহ ভুল নম্বরে ফোন করা থেকে বিরত থাকতে হবে। এমনটাই জানিয়েছেন সাইবার বিশেষজ্ঞরা।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাস থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত ১২০ কোটি ৩০ লাখ টাকা ডিজিট্যাল অ্যারেস্টের মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছে প্রতারকরা। এছাড়াও বিনিয়োগের টোপ দিয়ে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে ২২২ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। এবং বিভিন্ন ভুয়ো ফ্রেন্ডশিপ অ্যাপের মাধ্যমে ১৩ কোটি ২৩ লাখ টাকা প্রতারকরা নিজেদের ঝুলিতে ভরেছে।